গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই পাল্টে যায় দেশের দৃশ্যপট। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সম্ভাবনার দুয়ার খোলে বিএনপির। দেড় দশক পর বিএনপিতে ফিরে আসে স্বস্তি। রাজধানীসহ সারাদেশে নেতাকর্মীরা বেশ উজ্জীবিত হয়। কিন্তু, এরই মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারাদেশের কিছু নেতাকর্মী। এতে দলের ভাবমূর্তি চরম আকারে ক্ষুন্ন হয়। বিব্রত হয় দলের হাইকমান্ড। তাই দলের শৃঙ্খলা ফেরাতে এবার হার্ডলাইনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের সিনিয়র থেকে তৃনমূল নেতা যারাই দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকা-ে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই নেওয়া হচ্ছে কঠোর ব্যবস্থা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ এবং যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে শোকজ করেছে দলটি।
গতকাল সোমবার বিএনপির দপ্তর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। চট্টগ্রামে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের গ্রুপের গাড়ি ব্যবহারের জন্য সালাউদ্দিন আহমেদকে এবং নরসিংদীতে দখলবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে খোকনকে শোকজ করা হয়েছে। শোকজ নোটিশে আগামী তিন দিনের মধ্যে তাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে।গত কয়েক দিনে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবকদলসহ অঙ্গসংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের শত-শত নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিসও দেওয়া হয়েছে বলে দপ্তরসূত্রে জানা গছে।
এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভিডিও বার্তায় বলেছেন, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকবে বিএনপি। কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে কোনো অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। গির্জা, মন্দির, প্যাগোডার নিরাপত্তা দিন। ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস দিয়ে মানুষকে মাপা যাবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ভূখ-ে বসবাসকারী সবার একটিই পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। তিনি আরো বলেন, আপনারা পরাজিত অপশক্তির পাতা ফাঁদে পা দেবেন না। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে চূড়ান্ত সফলতায় নিতে হলে কেউ দখলদারত্বে লিপ্ত হবেন না, দখলদারত্বে সহায়তা করবেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একটি মহল ছাত্র-জনতার বিজয়কে নস্যাতের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে । গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার বিএনপির বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে কথা বলে পুরো দলকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে, দলের পক্ষ থেকে নজর রাখা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বারবার সর্তক করা হচ্ছে। এরপরও যারা দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদেরকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে সুনিদিষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতিতে দল। প্রতিদিনেই অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগের মানদন্ডে নির্ধারন হয় বহিস্কার ও কারন দর্শানোর নোটিশ। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে দলটি। গত রোববার রাতে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এর আগে দিন শনিবার এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরাতে সহযোগিতার ঘটনায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির শীর্ষ তিন নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় দলটি। বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবর রহমান শামীম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। বিএনপি থেকে নোটিশ পাওয়া দলটির নেতারা হলেন- চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, প্রথম যুগ্মআহ্বায়ক এনামুল হক এনাম এবং কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়া। তার আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে কালুরঘাট শিল্প এলাকার (বিসিক) মীর গ্রুপের মালিকানাধীন একটি ওয়্যারহাউস থেকে একে একে ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়।
এদিকে, সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগে ভিত্তিতে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভালুকা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত রোববার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বহিষ্কারাদেশ দেওয়া হয়। এরআগে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আতঙ্ক ছড়ানো বক্তব্য দেওয়ায় শাস্তি পেয়েছেন দলের উত্তরাঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, পুকুর দখলে গিয়ে বহিষ্কার হয়েছেন বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক শিরিন আক্তার।
মাত্র এক সপ্তাহে ১৭ জেলা থেকে অন্তত ৪৪ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করছে দলটি। এরমধ্যে যুবদলের ২৭ জন, ছাত্রদলের ১০ জন, বিএনপির ছয়জন ও স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন রয়েছেন। এছাড়া, তিন জেলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অন্তত ৪২ নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর কদমতলী থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ককে বহিষ্কার এবং আরও ছয় নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ককে বহিষ্কার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের দুই সহ-সভাপতিকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। খুলনায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পাইকগাছা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এসএম এনামুল হককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বরিশালে জেলা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক, ঠাকুরগাঁওয়ে জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও পঞ্চগড় পৌর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিবকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। যশোরে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ১৩ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
পাশাপাশি জেলাগুলোতে তৃণমূল পর্যায়ের অন্তত ৩৫ জন বিএনপি নেতাকে সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়াও ঝালকাঠিতে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে জেলা ও নলছিটি উপজেলা যুবদল আহ্বায়কদের বহিষ্কার করা হয়েছে। একই কারণে সদর উপজেলার উপ-প্রচার সম্পাদককে বহিষ্কার করেছে জেলা বিএনপি। যুবদলের লক্ষ্মীপুরে চারজন, পিরোজপুরে চারজন, লালমনিরহাটে তিনজন, গাজীপুর, নোয়াখালী, মাগুরা ও ঝিনাইদহে দুজন করে এবং নরসিংদীতে একজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মাগুরা পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ককেও বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়া জেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক এস এম তাজুল ইসলামকে বহিষ্কার করেছে দল।
গত শনিবার বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক মো. তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বগুড়া জেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক এস এম তাজুল ইসলামকে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. একরামকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় কবিরহাট উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরাফাতের রহমান হাসান স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কাপ্তাই উপজেলা বিএনপির সদস্য মো. নুরুল আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত রোববার রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন সাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
যুবদল ও ছাত্রদল সূত্র জানিয়েছে, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকা-ে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যুবদল এ পর্যন্ত ১২ জনকে বহিষ্কার ও অন্তত ৫ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। ছাত্রদল গত চার দিনে তিনজনকে বহিষ্কার ও একজনকে সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল জেলা ছাত্রদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল খান, ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক বি এম আলমগীর কবির ও পঞ্চগড় পৌরসভার সদস্যসচিব শামিম ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়। আর চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আসিফ চৌধুরীকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আরও তিনজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। যুবদল থেকে বহিষ্কৃত ১২ নেতা হলেন সংগঠনের চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সহসভাপতি নাসিম চৌধুরী ও জাহিদ হোসেন, গাজীপুর মহানগর যুবদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ইমরান রেজা, শ্রীপুর উপজেলার সদস্য সচিব মাইদুর রহমান খান, ঝিনাইদহ জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ মোশতাক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান, নরসিংদী জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল, নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার আহ্বায়ক বেলাল হোসেন, চাটখিল উপজেলার সদস্যসচিব বেলায়েত হোসেন, মাগুরা সদর উপজেলার সদস্যসচিব শাকিব মাহমুদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের গেন্ডারিয়া থানার সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম, কদমতলী থানার ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের আহ্বায়ক আসিফ মামুন। এর বাইরে স্বেচ্ছাসেবক দল মাগুরা পৌর শাখার আহ্বায়ক মারুফ হোসেনকে সব পদ থেকে বহিষ্কার করেছে।
মানিকগঞ্জে যুবদলের দুই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সুজাউদ্দিন বুলবুল ও শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনির। ফরিদপুর মহানগর যুবদলের সভাপতি বেনজির আহম্মেদ তাবরিজ, পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার আহবায়ক আবুল কালাম মল্লিক, মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী ইউনিয়নের সদস্য জামাল জোমাদ্দার, গজীপুর জেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক মফিকুল ইসলাম সোহেল, মহানগর শাখার গাছা থানার আহবায়ক কামাল উদ্দীন ও সাতক্ষীরা জেলা শাখার তালা উপজেলার কুমিরা ইউনিয়ন যুবদলের আহবায়ক মো: সেলিম রেজা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে দপ্তরের দায়িত্বে থাকা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নানা অপকর্মে জড়িতরা বেশির ভাগই ‘অনুপ্রবেশকারী’। দলের কোনো পদ-পদবিতে নেই। ছিলেন না কোনো কর্মসূচিতে। আন্দোলন-সংগ্রামেও দেখা যায়নি বিগত দিনে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারাই এখন বিএনপির ‘নেতাকর্মী’ সেজে গেছেন। দাপট দেখাতে শুরু করেছেন নিজ নিজ এলাকায়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দখল, চাঁদাবাজি আর অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। এ পরিস্থিতিতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ কথিত নেতাকর্মীর বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তও রয়েছে।
স্বদেশ প্রতিদিন/এমআর