সারাদেশে কয়েক দিন ধরেই এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় গত এক মাসে ৫৬৮ জনেরও বেশি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিনিয়ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান দিচ্ছে। এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানায় এবং স্থাপনায় হামলা ও লুটপাট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আতঙ্কের মধ্যে রাজধানীসহ পুরো দেশ প্রায় পুলিশশূন্য হয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, রাজধানীতে অনেক এলাকায় রাতে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এতে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত সোমবার থেকে দেশে শুরু হয় ব্যাপক নৈরাজ্য। ডাকাতির পাশাপাশি লুটপাট, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ মানুষের বাসাবাড়িতে হামলা চালিয়ে করা হয় অগ্নিসংযোগ। সেই থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে চলতে থাকে ব্যাপক লুটপাটসহ নানা অপরাধমূলক কাজ। যারা ডাকাতি, লুটপাট করছে তাদের বেশির ভাগ উঠতি তরুণ।
নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে মানুষ। ডাকাতি ঠেকাতে অনেক এলাকায় রাতভর পাহারা দিচ্ছে এলাকাবাসী। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বসিলা, কালশী, ইসিবি চত্বর, উত্তরা, খিলগাঁও, বনশ্রী, আফতাবনগর, হাতিরঝিল, রূপনগর, ভাটারা, খিলক্ষেত, যাত্রাবাড়ী, ও ধানম-ি এলাকায় ডাকাতির চেষ্টা হচ্ছে বলে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে। আতঙ্ক না হওয়ার জন্য কিছু এলাকায় রাত জেগে পাহারা বসিয়েছে ছাত্র-জনতা। শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন রাজধানীবাসী।
কোথাও কোথাও মসজিদের মাইকে দেওয়া হচ্ছে সতর্কবার্তা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও পোস্ট করা হচ্ছে এমন তথ্য। গত বুধবার গভীর রাতে কাজীপাড়ার বাঁশপট্টি এলাকায় একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে ও আদাবরে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
ছিনতাই, লুটপাট ও ডাকাতি ঠেকাতে নিজ নিজ এলাকা পাহারা দিচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা। রাতভর পাহারায় অস্ত্রধারী ডাকাতও আটক হয়েছে জনতার হাতে। স্থানীয়দের সতর্কতায় এক রাতে ধরা পড়েছে একজন অস্ত্রধারী ডাকাত। মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড এলাকার বেড়িবাঁধ ইউল্যাব ক্যাম্পাসের বিপরীতে ওই ডাকাত আটক হয়।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ব্যবসায়ী মো. শিপন বলেন, ‘ওষুধের দোকান বন্ধ করে গত বুধবার রাত ১০টার দিকে শোমসপুর বাজার থেকে জানিপুরের সড়ক দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। এ সময় পথে একদল ডাকাত আমাকে আটকে সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। বাধা দিতে গেলে মারধর করে।’
একইভাবে পাবনার আটঘরিয়া পৌর এলাকার উত্তরচক মহল্লায় এক সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে। ডাকাতদল টাকা, স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ২৫ লাখ টাকার মালপত্র লুটে নিয়ে যায়।
আটক হয়েছে যেসব ডাকাত
সূত্র জানায়, মিরপুরের পল্লবী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়েছে ১৭ জন। আটক হওয়া কয়েকজন ডাকাত এলাকাবাসীর মারধরের সময় জানিয়েছে, নাহিদ নামের এক যুবক তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে নামিয়েছে এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০০ যুবক সংগ্রহ করে এই কাজে লাগাচ্ছে শহিদ। শহিদ একজন ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসী।
সারা দেশে ডাকাতি
ভুক্তভোগী এলাকাগুলোর বেশির ভাগ মানুষ জানায়, সবচেয়ে বেশি ডাকাতি ও লুটপাট চলছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসায়। রাজধানীর বাইরে সাভার, আশুলিয়া, বগুড়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, টাঙ্গাইলের নাগরপুর, মানিকগঞ্জ, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মুন্সীগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত সোমবার রাত থেকে ডাকাতি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
নতুন আইজিপি ময়নুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর সব মেট্রোপলিটন এলাকা, জেলা, নৌ, রেলওয়ে ও হাইওয়ে থানার কর্মকর্তা ও ফোর্সকে নিজ নিজ পুলিশ লাইনে যোগদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সংঘর্ষ-সহিংসতায় যেসব ছাত্র, সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্য হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন, প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগে লুটতরাজ ও ধ্বংসাত্মক কাজে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান। তিনি বলেছেন, যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ওদিকে গাজীপুরে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে তিন জঙ্গিসহ ছয় বন্দি নিহত হয়েছেন। এ সময় কারাগার থেকে পালিয়ে গেছেন ২০৯ বন্দি। নিহতদের মধ্যে হলি আর্টিজেন হত্যাকা- মামলায় দ-প্রাপ্ত তিন জঙ্গি ছিলেন।
গুজবে কান না দিতে বিজিবির অনুরোধ
রাজধানীতে ডাকাতি কিংবা জননিরাপত্তাহানিকর কর্মকা- প্রতিরোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) জানাতে বলা হয়েছে। গতকাল বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে ডাকাতি অথবা জননিরাপত্তাহানিকর কর্মকা- প্রতিরোধে বিজিবিকে জানান। বিজিবির সহায়তার জন্য যোগাযোগ করুন ০১৭৬৯-৬০০৫৫৫ ও ০১৮৮৯-৬০০৫৫৫ নম্বরে।
এ ছাড়া সীমান্ত এলাকা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সবাইকে সচেতন থেকে গুজবে কান না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
পুলিশবিহীন অরক্ষিত রাতে তরুণ-কিশোরদের আনাগোনা মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। গণ-আন্দোলনে সরকার পতনের পর কারখানা খুললেও নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। পুলিশ না থাকায় কারখানা ও তার আশপাশের এলাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। চলমান পরিস্থিতিতে কয়েকটি কারখানায় আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার জন্য বর্তমান সেনাপ্রধানের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, সারা দেশে কিছু দুষ্কৃতকারী তা-ব চালাচ্ছে। তাদের রুখতে না পারলে পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে যাবে। দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংসযজ্ঞ অবশ্যই রুখে দিতে হবে। অনেকে বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস করতে পারছেন না। কারখানায় পণ্যের স্তূপ হয়ে আছে। যদি পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করা যায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা যায়, তাহলে সামলে ওঠা সম্ভব হবে।
স্বদেশ প্রতিদিন/এমআর