রাত ঠিক ১২ টা বেজে ১ মিনিট। এক দীর্ঘশ্বাস হতাশা নিয়ে থানায় বসে অনিশ্চয়তায় প্রহর গুনছেন শিক্ষক তার ছাত্রকে নিয়ে। তিনি তো আর ভুলে যাননি তিনি শামসুজ্জোহার উত্তরসূরী। ঠিক তাই বুকে ধারণ করে আকাশসম আশা নিয়েই বসে বসে ভাবছিলেন আমরা শিক্ষক আমরা তো আছি, এখনো মনে হচ্ছে ছাত্রদেরকে ছেড়ে দেবে। এমন করেই কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন। শুধু তিনিই নন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো বিশজন শিক্ষক আরামের ঘুম বিসর্জন দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন থানায়।
দীর্ঘ সাড়ে নয় ঘন্টার সমাপ্তি। রাত বারোটার ঠিক ঘন্টাখানেক পরই হঠাৎ আনন্দ পুরো থানা জুড়ে। আমাদের ছাত্রদেরকে তো ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। খুশি হয়ে নিউটনকে বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক আ. আল মামুন। তৎক্ষনাৎ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বেরিয়ে আসলেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আশা নিয়ে রাত জেগেছিলেন হয়তবা আমাদের ভাইদের ছেড়ে দেবে, ঠিক তখনই এমন সংবাদ পেয়ে মুহূর্তেই পুরো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে রাজশাহীর মতিহার থানায় এ ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশজন শিক্ষক আপ্রাণ চেষ্টা করে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর রাত ১টার দিকে আটক তিন ছাত্রকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। আটক তিনজন হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সৈয়দ সামিউল বাসিত ও মাজেদ হাসান এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাইম ইসলাম।
শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা গেছে, ৩১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে দুপুরে রাজশাহীর সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজশাহী আদালতের মূল ফটকের সামনে থেকে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির ডাক দেয়। তবে, পথে পুলিশের বাধার কথা চিন্তা করে তাঁরা কর্মসূচি পরিবর্তন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে থেকে যাত্রা শুরু করার ঘোষণা দেয়। এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে আসার সন্দেহে দুপুরের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের সামনে থেকে বাসিত ও মাজেদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে থেকে নাইমকে আটক করে পুলিশ।
খবর জানাজানি হওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন, সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন ও কাজী মামুন হায়দার, নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক হাবিব জাকারিয়া ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রোবাইদা আখতার, ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনকসহ অন্তত ২০ জন শিক্ষক সাড়ে ৯ ঘণ্টা থানায় অবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে আনেন।
এ ব্যাপারে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মোবারক পারভেজ বলেন, 'কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরসহ নানা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাস্তায় ব্যাগ নিয়ে সন্দেহভাজন অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে দেখে এ ধরনের অপরাধ ঘটাতে পারে মর্মে যথেষ্ট সন্দেহ হওয়ায় তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের তিনজনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।'
শিক্ষার্থীদের আটকমুক্ত করার পর অবস্থান করা বেশ কয়েকজন শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে পোস্ট করে জানিয়েছেন। মুহূর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে সংবাদটি।
শিক্ষার্থীরাও সংবাদ পেয়ে তাঁদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে বিভিন্ন পোষ্ট করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ লিখেন, 'এনারাই হলেন আমাদের পিতৃতুল্য আসল অভিভাবক। সাহস আছে বটে, ছাত্রদের নিয়েই বাসায় ফিরেছে। আমরা আপনাদের মতো শিক্ষক পেয়ে গর্ববোধ করছি।'
এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাত ১টার দিকে সেলিম রেজা নিউটন লিখেছেন, 'সাড়ে ৯ ঘণ্টা থানায় অবস্থান করার পর অর্ক আর মাজেদকে মুক্ত করে নিয়ে থানা থেকে বের হয়েছি। আমরা আশা ছাড়িনি, আমাদের বিশ্বাস ছিলো তাদের ছাড়তে পারবো। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ, শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ফোকলোর বিভাগের বিভাগের সহকর্মীরা পুরো সময় থানায় ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, উপাচার্য মহোদয় এবং প্রক্টর কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা করেছেন। অবশেষে সফল হয়েছি।'
তিনি আরো বলেন, 'শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষার্থীও আটক ছিলেন, তাঁকেও আমরা ছাড়িয়ে এনেছি। তিনি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে অন্যদের চেয়ে আধা ঘণ্টা আগে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।'
অবস্থাকারী শিক্ষক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ. আল মামুন জানান, 'সেই বিকেল ৪টা থেকে জুঝে জুঝে রাত ১টায় আমরা ৩ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে ফিরলাম। রাবি প্রশাসন যথেষ্ট হেল্প করেছে। ধন্যবাদ তাদের প্রাপ্য। ন্যায্যতার সংগ্রাম চলবে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক ড. আমীরুল ইসলাম কনক বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীদের আটক করার খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক মতিহার থানায় ছুটে যাই। আসলে শিক্ষার্থীদের ভুলটা কোথায়? কিসের জন্য তারা তাদেরকে আটক করেছে। শিক্ষার্থীরা অধিকার আদায়ের জন্য কথা বলছে। দুই-তিন ঘণ্টা অবস্থান করার পর আমরা তাদেরকে মুক্ত করি। আমরা এখনো বেঁচে আছি। আমি শিক্ষকদের বলবো, এখনো সময় আছে ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আসাবুল হক বলেন, 'আমরা তিনজন শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনতো সক্ষম হয়েছি। আরেক থানায় কথা বলেছি, যদি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ হয় তাহলে তাদেরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে, তারা খোঁজখবর রাখছেন।' এসময় বাকিদের মুক্ত করতে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ শিক্ষার্থীকে আটক করে নগরীর দুই থানা-পুলিশ। এরমধ্যে তিনজন এখনো ছাড়া পাননি। নগরীর মহিষবাথান এলাকা থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রিফাত হাসান এবং আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রত্যয়কে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে, প্রত্যয়কে রাজপাড়া থানা পুলিশ ও রিফাত হাসানকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আটক করে। তাদের ছাড়াতেও শিক্ষকরা বিকেলে থানায় উপস্থিত হন। তবে, আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের ছাড়া হয়নি।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, 'তিনি ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছেন। তিনি কথা বলেছেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তারা বলেছে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেবে।'
ইংরেজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক রোবাইদা আখতার বলেন, "শিক্ষার্থীদের সবকিছু চেক করেছে তারা। তাদের শিক্ষার্থীর ব্যাপারে পুলিশ খুবই ইতিবাচক। তারা বলছে কিছু ‘ফরমালিটিস মেইনটেন’ করে ছেড়ে দেবে।"
স্বদেশ প্রতিদিন/এমআর