
বেসরকারি এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড ও ডেসকোর গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে সেগুলো জুয়ায় বিনিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। বেসরকারি ওই ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে আটটি বুথের মাধ্যমে ডেসকো গ্রাহকদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্রাঞ্চের অধীনে গ্রাহকদের টাকা জমা নেওয়ার বিষয়টি মনিটরিং করার কথা। কিন্তু ২০১৯ থেকে কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের ইচ্ছামতো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন উপেক্ষা করে বুথগুলো পরিচালনা করছে। এর ফলে গ্রাহকের কাছ থেকে সংগৃহীত বিল ডেসকোর অনলাইনে জমা না দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করে আসছে একটি চক্র। এসব বিষয় অডিট রিপোর্টে ধরা পড়েছে।
জানা গেছে, এক বছরেই শুধু একটি বুথ থেকেই এক কোটি ২০লাখ টাকারও বেশি লোপাট করা হয় যা ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে উঠে আসে। পরবর্তীতে আবারো সিন্ডিকেটটি অভিনব কায়দায় গ্রাহকদের অর্থ লোপাট করতে থাকে এবং পরবর্তীতে ডেসকো এবং ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে হাতে-নাতে ধরাও পড়ে। ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৩ মার্চ ২০১৮ সালের ৬৮তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক একই বছরের ১২ নভেম্বরে ডেসকো ও এনআরবি ব্যাংকের যৌথ চুক্তি সম্পাদন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি অনুমোদন দেওয়ার পর ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংকটির পল্লবী শাখায় ডেসকোর বিল জমা নেওয়া শুরু করে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ডেসকোর পল্লবী ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী এনআরবি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের কাছে বিলের টাকার অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরেন।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত গ্রাহকের জমাকৃত বিল ডেসকোর অনলাইনে সময়মতো জমা করা হয়নি। গ্রাহকের বিল সময় মতো পরিশোধিত না হওয়ায় ডেসকোর টিম সংযোগ বিছিন্ন করতে গেলে গ্রাহকরা বিল পরিশোধের কাগজ দেখালে বিষয়টি ডেসকো কর্তৃপক্ষের নজরে আসে।
ডেসকোর অভিযোগের পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মিরপুর ব্রাঞ্চের শাখা ব্যবস্থাপককে বিষয়টি অবহিত করে এবং বিষয়টি সুরাহার দায়িত্ব দেয়। এ অবস্থায় ব্যবস্থাপক নিজে বিষয়টির সুরাহা না করে মার্কেটিং বিভাগের নুপুর পাল ও এইচআর বিভাগের বোরহান চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন। নুপুর পাল পল্লবী ডেসকো অফিসে বিক্রয় ও বিপণন বিভাগে ৯ মার্চ ২০২২ তারিখে যোগদান করেন। এরপর থেকেই গ্রাহক বিলের টাকা জমা দেওয়ার বেশ কয়েকদিন পর তা ডেসকোর অনলাইনে জমা করা হয়। নুপুর পাল ১০ মার্চ ২০২২ তারিখে অফিস কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অফিস ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে অফিসের অনলাইন ও ক্যাশের মধ্যে ৮০ লাখ টাকার তারতম্য ধরা পড়ে! সর্বশেষ ১৩ মার্চ ২২ তারিখে নুপুর পাল ও বোরহান ডেসকো পল্লবী বুথে গিয়ে ১ কোটি ১৫ লাখ ১ হাজার ৯৭২ টাকার অনলাইন ও ক্যাশের গড়মিল পান। তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আব্দুল জাবেদ বিষয়টি অবগত হওয়ার পর ব্যাংকের শীর্ষ কর্তকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
পরবর্তীতে অডিট টিমের অনুসন্ধানে থেকে জানা যায়, অভিযুক্তদের দিয়েই বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অডিটের পর্যবেক্ষণ সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক ধারণা থেকে নুপুর পাল, বোরহান চৌধুরী ও তাহসিন তামান্না বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে অডিট টিম। নুপুর পালের চাকরির বৃত্তান্ত পাওয়া গেলেও বোরহান চৌধুরী ও তাসনিম তাহসিনের কোনো ধরনের চাকরি বৃত্তান্ত অডিট টিম খুঁজে পায়নি!
অডিট সূত্রে আরও জানা যায়, তত্ত্বাবধানের কেউ না থাকায় মিরপুর পল্লবী বুথে অনিয়মের ঘটনা ঘটে। ব্যাংক থেকে নিযুক্ত তাহসিন তামান্না নিজে বিল আদায় করলেও তা অনলাইনে পোস্টিং দিতেন বোরহান চৌধুরীর আইডি থেকে। বেশির ভাগ সময় তাহসিন তামান্না তার নিজের আইডি ব্যবহার করতেন না বলেও অডিটে প্রমাণ পাওয়া যায়। তার আইডি হারিয়ে যাওয়ায় তিনি বোরহানের আইডি ব্যবহার করতেন বলে অডিট টিমকে জানালেও তা তদন্তে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।
ডেসকোর গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল সংগ্রহের বিষয়ে ব্যাংকটির কোনো নিয়ম ছিলো না। তবে অনিয়ম ধরা পড়ার পরে নতুন করে তা তৈরি করা হয়েছে। বায়োমেট্রিক হাজিরা ও সিসি ক্যামেরার কোনো অস্তিত্ব অডিট পরিচালনা কমিটি পায়নি। ডেসকোর ওয়েব সাইটে এনআরবি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিটি এনআরবি কর্মাশিয়াল ব্যাংকের নাম উল্লেখ করা হয়। অনিয়ম করার পূর্ব প্রস্তুতি থাকার ফলে বিলের কোনো সিরিয়াল দেওয়া হতো না। এমনকি যে বিল পরিশোদের জন্য গ্রাহককে যে কপি দেওয়া হতো তা ডেসকোর সরকারি সফটওয়্যার থেকে প্রিন্ট দেওয়া হতো না। দিন শেষে সংগ্রহকৃত টাকা জি-ফোর নিরাপত্তা রক্ষীদের মাধ্যমে এনআরবি ব্যাংকটির মিরপুর শাখায় পাঠানো হতো। আর এই অর্থ শুধুমাত্র একটি হাতে টাইপকৃত কাগজের মাধ্যমে ব্যাংকে পাঠানো হতো। বুথ থেকে প্রতিদিনের পাঠানো অর্থ ও কাগজ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সমন্বয় করে ভাউচার,ক্যাশ ও অনলাইন দেখভালের কেউ ছিলো না। যদিও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নুপুর পালকে ডেসকো’র বিল আদায়ের বুথগুলোর তত্ত্ববধানের দায়িত্ব দেন। তার দায়িত্বে অবহেলা ও ডেসকো কর্তৃক অভিযোগের পরেও তা নিয়ে টালবাহানার প্রমাণ উঠে আসে অডিট প্রতিবেদনে।
প্রতিনিয়ত ছোট আকারের অর্থিক অনিয়ম ধরা না পড়ায় জানুয়ারি ২০২১ থেকে ১৪ মার্চ ২০২২ এই সময়ের মধ্যে ডেসকোর গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতিদিন আদায়কৃত অর্থের পুরোটাই বুথ থেকে ব্যাংকে পাঠানো হয়নি। সামান্য কিছু অর্থ বোরহান চৌধুরী ব্যাংকে জমা দেন। বিষয়টি নিয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের অনাগ্রহও তাহসিন তামান্না ছুটিতে থাকায় বোরহান চৌধুরী পূর্বের এবং এই সময়ের আদায়কৃত অর্থের মধ্যে ১ কোটি ১০ লক্ষ ৬৯ হাজার টাকাসহ মোট ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা আত্মসাত করেন। আত্মসাতকৃত অর্থ জুয়া ও বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বোরহান চৌধুরী খরচ করেছেন বলে অডিট টিমের কাছে স্বীকার করেন। এর মধ্যে তিনি ১০ লাখ টাকা ফেরত দেন বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অডিট প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, পল্লবী বুথ চালু হওয়ার শুরু থেকেই ব্যাপক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো এবং মানসম্মত পরিচালনা পদ্ধতি মানা হয়নি। দীর্ঘদিন ব্যাংকে চাকরির সুবাদে বোরহান চৌধুরী অর্থ আত্মসাতের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত হন। ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঠিক তত্ত্বাবধান না থাকায় এই অনিয়ম সংঘটিত হয়। গত ৭ আগস্ট ২০২২ তারিখ পর্যন্ত ব্যাংক বোরহান চৌধুরীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা উদ্ধার করলেও বাকি টাকা কবে নাগাদ আদায় হবে তা কেউ বলতে পারছে না।
/এম/