দেশের সমতল ভূমিতে বসবাসরত অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির আর্থ সামাজিক ও জীবন মান উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয়েছিলো এক বৃহৎ প্রকল্প। লক্ষাধিক অনগ্রসর নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জন্য নেওয়া ওই প্রকল্পের আকার প্রায় চারশো কোটি টাকা। প্রকল্পের টাকার সুফল প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা তো পায়ই-নি, বরং হয়েছে বিপুল নয়-ছয়।
প্রকল্প পরিচালক নিজেই ঠিকাদারের সঙ্গে প্রকল্প বাজেটের বেশির অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। সঠিকভাবে অর্থ ব্যয় না করে উপকারভোগীদের তালিকায়ও গোজাঁমিল করেছেন। আর্থিক লাভালাভের ভাগ পেয়ে প্রকল্প পরিচালককে বিলাসবহুল হ্যারিয়ার জীপ গাড়িও উপহার দিয়েছেন ঠিকাদার। ওই প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হলেন অসীম কুমার দাস।
উন্নয়ন প্রকল্পটির কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ উঠার পর সার্বিক বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন মাঠে নেমেছে।
দুদক সূত্র জানায়, গত ৯ অক্টোবর প্রকল্পটির পরিচালক (পিডি) অসীম কুমার দাসের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক অনুসন্ধান অনুমোদন করেছে। এর আগে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি প্রকল্পটির নানা অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সবিস্তার অভিযোগ করা হয়।
সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির আর্থ সামাজিক ও জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়াধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক ৩৯১ কোটি ৫২ লক্ষ ৩১ হাজার টাকায় ০১/০৭/২০১৯ হতে ৩০/০৬/২০২৩ পর্যন্ত প্রকল্পটি ২৯টি জেলার ২১০টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টির দারিদ্র বিমোচন, জীবন যাত্রার মান উন্নয়, প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ও উন্নতমানের ঘাস উৎপাদন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হয়। প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে উপকার ভোগীদের জন্য শত শত কোটি টাকার কেনাকাটা করা হয়। আর এই কেনাকাটাতেই অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের অভিযোগ উঠে।
প্রকল্পের মাধ্যমে ২৯টি জেলার ২১০টি উপজেলায় ১৩৭৯৭৬টি সুফলভোগী পরিবারের মধ্যে উন্নত জাতের ক্রসব্রিড গাভী, মোটাতাজাকরনের জন্য গরু, সোনালী মুরগি, খাকি ক্যাম্বেল হাঁস, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ সরবরাহ করার জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) উল্লেখ করা হয়। যেখানে ক্রসব্রিড গাভী-৬৯১০টি, মোটাতাজাকরণের জন্য গরু-৬৯১০টি, সোনালি মুরগী-৩৪৫৭৮টি, খাকি ক্যাম্বেল হাঁস-৩৪৫২৮, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল-২০২৪৬, ভেড়া-২৬৩৩৯টি ও মহিষ ৮৪৬০টি উল্লেখ করা হয়। প্রতি প্যাকেজে অস্থায়ী ঘর নির্মাণ বাবদ গাভী, মহিষ ও মোটাতাজাকরণ গরু বাবদ ৭০০০.০০ টাকা বরাদ্দ হয়েছে, ছাগল-ভেড়ার জন্য অস্থায়ী ঘর নির্মাণ বাবদ ৫০০০.০০ এবং হাস মুরগীর অস্থায়ী ঘর নির্মাণ বাবদ ৩০০০.০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়।
উন্নত জাতের ক্রসব্রিড গরু ডিপিপি মূল্য ৬১০০০.০০ টাকা, মোটাতাজাকরণের জন্য গরু ৪৩০০০.০০, সোনালি মুরগী ৫০০০.০০ (২০টি মুরগী), মোটাতাজাকরণের জন্য গরু ৪৩০০০.০০, সোনালী মুরগি ৫০০০.০০ (২০টি মুরগী), খাকি ক্যাম্বেল হাঁস ৬০০০ (২০টি হাঁস) ব্ল্যাকব্যাংগল ছাগল-১২০০০.০০, ভেড়া ১২০০০.০০ ও মহিষ-৫৫০০০/-টাকা নির্ধারণ করা হলেও এসব পশুপাখি কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ মেলে। প্রতি প্যাকেজে সুফলভোগিদের মধ্যে একটি গাভী, একটি মহিষ, দুটি ছাগল, দুটি ভেড়া, ২০টি হাস,ও ২০টি মুরগি প্রদান এবং প্রতিটি প্যাকেজের প্রতিটি প্রাণির জন্য ঘর নির্মাণ ও তিন মাসের খাদ্য প্রদান ডিপিপিতে সংস্থান আছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের ভিত্তিতে ২৯টি জেলার ২১০টি উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিকে চারটি এলাকা হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। এলাকাগুলো হল: উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল , মধ্যাঞ্চল ও উপকুলীয়-দক্ষিণাঞ্চল।
এসব এলাকার ১,৩৭,৯৭৬ টি সুফলভোগী পরিবারের মাঝে অনুদান বিতরণের উদ্যোগ হিসেবে কাজ করবে বলে প্রকল্পে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই পরিবারগুলোর মাঝে সাতটি প্যাকেজে উন্নত জাতের ক্রস ব্রিড জাতের ৬৯১০টি গাভী প্রতিটি পরিবারে একটি করে, অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ ও তিন মাসের খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। একইভাবে ৩৪৫৭৮টি পরিবারকে ২০টি করে মুরগি, অস্থায়ী বাসস্থান এবং খাদ্য সরবরাহের কথা। সুফলভোগীদের মধ্যে ৩৪৫২৮টি পরিবারকে ২৯টি করে হাঁস ২০২৪৬ টি পারবারকে দুটি করে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, ২৬৩৩৯টি পরিবারকে ভেড়া, ৮৪৬০টি পরিবারকে একটি করে মহিষ ও অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ এবং তিন মাসের খাবার সরবরাহের বিষয়টি ডিপিপিতে উল্লেখ ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, প্রাণিক্রয় খাতে সরকারের অর্থের অপচয় হয়েছে ৭১ কোটি ৮১লক্ষ ৬১,০০০ হাজার টাকা যা দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগে উল্লেখও করা হয়। অভিযোগ থেকে জানা যায়, প্রকল্প পরিচালক নিজেই ঠিকাদারের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করে সরকারি ওই অর্থ নয়ছয় করেছেন। সঠিকভাবে অর্থ ব্যয় না হওয়া ও উপকারভোগীদের তালিকায় গোজাঁমিল থাকায় প্রকল্পটি নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি হয়।
ডিপিপিতে প্রাণী খাদ্য সরবরাহের জন্য ৩৩ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও তার অর্ধেক ব্যয় করার অভিযোগ রয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জেনটেক ইন্টারন্যাশনালের মালিক ধীরেন দাস ও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) অসীম কুমার দাস যোগসাজশ করে সরকারি ওই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। ঠিকাদার খুশি হয়ে প্রকল্প পরিচালককে একটি বিলাসবহুল হ্যারিয়ার জীপ গাড়িও উপহার প্রদান করেছেন যার রেজি. নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৮৪৫৩ বলে দুদকের দাখিলকৃত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। সাবেক একজন মন্ত্রীর এপিএসের সাহায্যে অসীম কুমার পিডি পদটি বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
প্রকল্পের অঞ্চল ভিত্তিক সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় প্রকল্প পরিচালক অসীম কুমার দাসের সঙ্গে। তিনি শুক্রবার সন্ধ্যায় স্বদেশ প্রতিদিনের কাছে দাবি করেন, যারা বিভিন্ন অনিয়মের কারণে চাকুরিচ্যুত বা বরখাস্ত হয়েছে, তারাই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দুদকে অভিযোগ করেছে। দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়টি তিনি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছেন।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এমদাদুল হক তালুকদারকে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় কয়েক দফা ফোন ও এসএমএস পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তার সাড়া মেলেনি। ফলে তার কোনো মন্তব্যও নেওয়া সম্ভব হয়নি।