পাঁচ তারকা হোটেল লা মেরিডিয়ানের মালিক আমিন আহমেদ ভূঁইয়া। তিনি অবৈধ সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে এমন কোনো পন্থা নেই যে সেটি ব্যবহার করেননি। পাশাপাশি বেসিক ব্যাংকের আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকেও অবৈধ সম্পদ বৈধ করার ক্ষেত্রে দিয়েছেন সার্বিক সহযোগিতা। দেশের স্মরণকালের আলোচিত অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আব্দুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে আমিন আহমেদের বিরুদ্ধে এখনো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থা।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, আমিন আহমেদ হোটেল ব্যবসার আড়ালে বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন। তিনি নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ৭০০ একর খাস জমি দখলও করেছেন। পাশাপাশি বিদেশে অর্থ পাচারেরও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি ঘরানার এই ব্যবসায়ী আবাসন, হোটেল, অবকাঠামো উন্নয়ন, অ্যাগ্রো ব্যবসাসহ নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। এসব ব্যবসার ভিত্তি তিনি গড়ে তুলেছেন অবৈধ ও অনৈতিকভাবে।
যেভাবে উত্থান
আমিন আহমেদ ও তার সহযোগীরা ২০০১ সালে বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঠিকাদারি ব্যবসার মাধ্যমে বৈধ-অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের টেন্ডার ও সারাদেশে বিভিন্ন সেতুতে টোল আদায়ের কাজ তারাই পারিবারিক ব্যবসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ছাড়াও সরকারি অন্যান্য দপ্তরের বড় বড় টেন্ডারের কাজও করতেন তারা। আর অর্জিত সম্পদসমূহ বাইরের বিভিন্ন দেশে পাচার করতেন। দুদকের অনুসন্ধানের সূত্র থেকে জানা যায়, আমিন আহমেদের এক ভাইয়ের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে তদন্ত এখন চলমান রয়েছে।
আমিন আহমেদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বিএনপি জোট সরকারের শেষে তারা দুই ভাই নোয়াখালীর চাটখিল ও লক্ষীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন নেন। পরে ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার নির্বাচন করতে না পারলে তাদের সংসদ সদস্য পদে আসীন হওয়া হয়নি। সম্ভাব্য বিপদ বুঝতে পেরে একই বছর দ্রুত পারিবারিক ব্যবসা ভাগাভাগি করে নিয়ে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন আমিন আহমেদ গং। আমিন আহমেদ লা মেরিডিয়ান ছাড়াও ‘বেস্ট হোল্ডিং’ ও ‘ক্যাপিটাল বনানী ওয়ান লিমিটেড’ -এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরবর্তী একটি আর্থিক লেনদেনের সূত্র ধরে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের ভাটা পড়ে আমিন আহমেদের। দ্রুতই ক্ষমতার পালাবদলে তিনি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মিশে যান। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মিশে লা মেরিডিয়ান হোটেলের বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে আইপিও শেয়ারের অনুমোদন গ্রহণ করে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে শতকোটি টাকা লুটে নেন এই আমিন আহমেদ। শেয়ার বাজার লুটের ওই ঘটনার তদন্ত এখন দুর্নীতি দমন কমিশনে চলমান। ইতোপূর্বে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে দুদক।
বাচ্চু-আমিন হাত ধরাধরি
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা চলমান। কিন্তু তার অবৈধ টাকা বৈধকরণ প্রক্রিয়ার সহযোগী লা মেরিডিয়ান হোটেলের মালিক আমিন আহমেদ দেশে থেকেও ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংশ্লিষ্ট অনেকে এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
দুদকের মামলা সূত্রে জানা যায়, আমিন আহমেদ ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার ৬ নং প্লটে ৩০.২৫ কাঠার জমি একশত দশ কোটি টাকা মূল্যে ক্রয়ের জন্য ৮ আগস্ট ২০১২ সালে একটি সমঝোতা চুক্তি করেন। চুক্তিপত্র সম্পাদনের সময় ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন বলে চুক্তিতে উল্লেখ করেন। কিন্তু জমি সাফ কবলা বা চূড়ান্ত রেজিষ্ট্রির সময় চুক্তিপত্র অনুযায়ী দাম উল্লেখ করা হয়নি।
দুদকের ভাষ্য, এ প্রক্রিয়ায় জমি কেনার নামে অবৈধ শতকোটি টাকা বৈধ করার চেষ্টা করেছেন বাচ্চু। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন হোটেল লা মেরিডিয়ানের মালিক আমিন আহমেদ। পরস্পর যোগসাজশে তারা সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১২ সালের ৮ জুলাই আসামি শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট বাজারসংলগ্ন ৬ নম্বর প্লটের ৩০ দশমিক ২৫ কাঠা জমি কেনার চুক্তি করেন আরেক আসামি আমিন আহমেদের সঙ্গে। জমির দাম ঠিক করা হয় ১১০ কোটি টাকা। চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের সময় ১০ কোটি টাকা পরিশোধ দেখানো হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী দুটি দলিলে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। যার মধ্যে ২০১২ সালের ১৬ অক্টোবর প্রথম দলিলে ১৮ কাঠা জমির দাম ৯ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে গ্রহীতা শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু, শেখ শাহরিয়ার পান্না ও শিরিন আক্তার।
একই বছর আরেক দলিলে ১২ দশমিক ২৫ কাঠার দাম ধরা হয়েছে ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। যেখানে গ্রহীতা শেখ সাবিদ হাই অনিক ও শেখ রাফা হাই। জমির রেজিস্ট্রি মূল্য ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন মূল্য ৯৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা কম দেখিয়ে অবৈধ আয় গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া জমির মূল্য কম দেখিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৮ কোটি ৫২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো স্বদেশ প্রতিদিনকে জানায়, জমি বেচাকেনা ও বাজার মূল্য গোপন করতে বাচ্চুকে সহযোগিতা করেছেন লা মেরিডিয়ানের মালিক আমিন আহমেদ। তিনি ১৩৪টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাদের আয়কর নথিতে জমির দাম দেখানো হয়েছে ২৪ কোটি ৬৪ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৪ টাকা। অর্থাৎ শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর আয়-ব্যয় ও প্রকৃত সম্পদের মধ্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে।
অভিযোগ ওঠে বেসিক ব্যাংকের আত্মসাৎ করা অর্থ হস্তান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে তা গোপন করেছেন চেয়ারম্যান বাচ্চু। তার এই অবৈধ অর্থের বৈধতা প্রদানে সহায়তা করেছেন আমিন আহমেদ। যা অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে এই ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালেই বাচ্চু ২০১২ সালে বেস্ট হোল্ডিং গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদের সঙ্গে জমি কেনার বায়না চুক্তি করেন। বায়না চুক্তি অনুযায়ী জমির মালিকানা যে ৫ জনের নামে তারা হলেন- শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু (৬ দশমিক ২৫ কাঠা), শেখ শাহরিয়ার পান্না (৬ কাঠা), শেখ শিরিন আক্তার (২ কাঠা), শেখ সাবিদ হাই অনিক (৮ কাঠা) ও শেখ রাফা হাই (৮ কাঠা)। দুদকের দায়েরকৃত মামলার আসামিরা হলেন- বেসিক ব্যাংকের আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই ওরফে বাচ্চু, তার স্ত্রী শিরিন আক্তার, তার ভাই শেখ শাহরিয়ার পান্না, বাচ্চুর ছেলে শেখ রাফা হাই, শেখ সাবিদ হাই অনিক ও হোটেল লা মেরিডিয়ানের মালিক আমিন আহমেদ।
সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য স্বদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে গত কয়েকদিন আমিন আহমেদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। ক্ষুদে বার্তাও পাঠানো হয়। পরে এক পর্যায়ে আমিন আহমেদের পক্ষ থেকে বেস্ট হোল্ডিং কোম্পানির একজন প্রতিনিধি স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুই দিন পর তিনি (আমিন আহমেদ) এ বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন।’ কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে আমিন আহমেদ নিজের স্বপক্ষে কোনো দালীলিক প্রমাণ বা লিখিত কোনো বক্তব্যও দেননি। উল্টো এই প্রতিবেদককে বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদটি না প্রকাশের অনুরোধ করেন। সর্বশেষ এরপর ৪ নভেম্বর বিকেল ৪.৩৮ মিনিটে ও ৭.৩৪ মিনিটে ক্ষুদে বার্তা ও ফোন কল দিয়েও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
/এম/