বুধবার ২৯ নভেম্বর ২০২৩
আওয়ামী লীগে কাক আছে কিন্তু কাকতাড়ুয়া কই
লুৎফর রহমান হিমেল
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩, ৫:৫০ পিএম
আওয়ামী লীগে কাক আছে কিন্তু কাকতাড়ুয়া কই

আওয়ামী লীগে কাক আছে কিন্তু কাকতাড়ুয়া কই

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পথচলার সাত দশক হয়ে গেছে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দলটি এখন টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। নানামুখী চড়াই-উৎরাই পেরোনো দলটি দীর্ঘ পথচলায় হোঁচট খেলেও কখনো থেমে যায়নি। এই পথচলায় দলটি বারবার অদম্যতার প্রমাণ দিয়েছে। এ দেশে রাজনৈতিক একটি সংস্কৃতি হলো- দল ক্ষমতায় গেলে দলের সবার বড় সুসময় আসে; বেশি সুসময় আসে অন্য দল থেকে আসা মধুলোভী হাইব্রিড নতুন নেতাকর্মীদের। গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগে দাপট দেখিয়েছে এই হাইব্রিড নেতারা। ফুলেফেঁপে এরা একেকজন ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে গেছে। সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনেও এদের বড় অংশ মনোনয়নের জন্য দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে। কোণঠাঁসা পুরনো আর ত্যাগী নেতারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে।    

আওয়ামী লীগে এখন যে সুদিন তা আর বলার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাসীন দলে শুভাকাঙ্খীদের ভিড় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের নৌকাতেও তাই গত পনেরো বছর ধরে শুভাকাঙ্খীদের ভিড়ে নড়াচড়া করার জো নেই। নতুন করে দলে নেতাকর্মীর সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। ফলে নৌকাতেও গা ঠাঁসাঠাঁসি করা এক অবস্থা। যারা পুরোনো-ত্যাগী, তারা অনেকটাই নৌকার গুলুইয়ের দিকে কোনঠাঁসা অবস্থায় কোনো রকমে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের বসবার জো-টিও নেই! তাদের অবস্থা অনেকটাই ‘ত্রাহি মধুসূদন’। যারা নতুন কিংবা লোক দেখানো শুভাকাক্সক্ষী, তাদের অবস্থানটা নৌকার ভাল ভাল সব জায়গায়। গত তিন নির্বাচনেই দেখা গেছে, ভোট এলেই নৌকায় এই ঠাঁসাঠাঁসি অবস্থা। এখন সবাই আওয়ামী লীগার। সবাই মনোনয়ন চায়। দলের বিপদে যারা ছিল না, বিরোধিতা করেছে, তারাও মনোনয়ন চায়। হঠাৎ দলে যোগ দিয়েছে, তারাও মনোনয়ন চায়। কেউ টাকার জোরে, কেউ লবিংয়ের জোরে মনোনয়ন শেষ পর্যন্ত বাগিয়েও নেয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া পরীক্ষিত ও ত্যাগীরা থাকে অবহেলিত। তারা দল ছাড়তেও পারেন না, মনের দুঃখ কাউকে বলতেও পারেন না।

২০০৯ সালে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে ‘ভূমিধস বিজয়ের’ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ৯৬-এর পর দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। বিপুল বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে ভুঁইফোড় সংগঠনও গড়ে ওঠতে থাকে তখন থেকেই। ওই সংগঠনগুলোতে নতুন আওয়ামী লীগাররা দলে দলে যোগ দিয়ে পুরোনোদের কোণঠাঁসা করে দিয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ সংগঠনগুলোকে ‘রাজনৈতিক দোকান’ বলা হচ্ছিল তখন থেকেই। এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারাও প্রধান অতিথি হয়ে যেতেন! ফলে, সংগঠনগুলোর সংবাদ গণমাধ্যমে আসত। মূলত, গণমাধ্যমে আসার কারণে নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের সভাপতি বা সেক্রেটারিরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধাও নিতেন এবং প্রভাব দেখাতেন। গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কারণে ওই সংগঠনগুলো মহামারির রূপ নিয়েছে। এই নবাগতরাই নানা নির্বাচনে প্রার্থীতা বাগিয়ে নিয়েছে। তাদের দাপটে পুরোনো এবং ত্যাগীরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ হয়ে আছেন পনেরো বছর ধরে।

এবারের নির্বাচনেও নতুন আওয়ামী লীগাররা সরব। যেভাবে চলছে তাতে বরাবরের মতো এবারো তাদের বেশিরভাগই মনোনয়ন বাগিয়ে নেবে। বাদ পড়বে দুঃসময়ে দলের হাল ধরা পুরোনো ত্যাগী নেতারা।

সুসময়ের এই আওয়ামী লীগারদের উদ্দেশ্য করেই আওয়ামী লীগের সভাপতি-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক একবার বলেছিলেন, ‘দুঃসময়ে কে আপন কে পর তা চেনা যায়। এখন সুসময়, তাই কাক ও কোকিল চেনা বড় দুষ্কর।’ অর্থাৎ তিনি দলে কাকদের যে বাড়-বাড়ন্ত সেটি অন্তত কবুল করে নিয়েছেন। অবশ্য এ কথা দলের শীর্ষ নেতারাও জানেন। নানা সভা-সমাবেশেও তারা এই ‘কাক’দের কথা উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না কখনো। ফলে দলে কাকদের দাপট আর ভিড় বাড়তেই থাকে!

এখন আওয়ামী লীগে কাকদের ভিড়টা এতো বেশি যে, সুবিশাল নৌকায় ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ অবস্থা। ফলে নবাগত যাত্রীদের নানাবিধ অপকর্মে মাঝেসাঝেই ডুবোডুবো হয়ে যায় নৌকা। অতীতে দেখা গেছে, যখনই নৌকায় শঙ্কট, তখনই নৌকার মাঝিমাল্লারা দু-একবার সতর্কতার হাঁক ছাড়ছেন। এরকম এক অবস্থায় একবার দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘প্রচার লীগ, তরুণ লীগ, কর্মজীবী লীগ, ডিজিটাল লীগ, হাইব্রিড লীগ আছে। কথা হাছা, সংগঠনে কাউয়া ঢুকছে। জায়গায় জায়গায় কাউয়া আছে। পেশাহীন পেশাজীবী দরকার নেই। ঘরের ভেতর ঘর বানানো চলবে না। মশারির ভেতর মশারি টানানো চলবে না।’ কিন্তু তার ওই হুঁশিয়ারি কথার কথা হয়েই আছে। দলে কাক প্রবেশ বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি কাকদের দাপটও। এবারের নির্বাচনেও সেই কাকদের তৎপরতা চোখে পড়ছে।

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতু যেভাবে বদলায়, আমাদের রাজনীতির মৌসুমও সেভাবে বদলায়। দল ক্ষমতায় আসে, সুদিনের আবহাওয়ায় মৌসুমী অতিথি পাখিরাও ভিড় করে। ক্ষমতা চলে যায়, অতিথি পাখিরাও উড়ে চলে যায় সুবিধাজনক দেশে। শুধু থেকে যায় দেশজ পাখিরা।

আওয়ামী লীগের নৌকায়ও এখন দলটির ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ আনন্দ-কলরব-কল্লোল চলছে। এ আনন্দ কলরব গত পনেরো বছর ধরেই চলছে। ওবায়দুল কাদের সাহেব সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি কাঠখোট্টা ভাষায় এই অতিথিদের ‘কাউয়া’ বলে না-ও ডাকতে পারতেন। এতো পাখি থাকতে কেন কাউয়া! আবার কাক-ও নয়! এমনিতে কাক নিয়েই নানা ওজর আপত্তি আছে কবি-সাহিত্যিকদের। সেখানে কাউয়া তো আরো বড় বেশি বেদনার ডাক।

যাই হোক, কাউয়া ডেকেছেন ঠিক আছে। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরসহ দলের শীর্ষ নেতারা কাউয়া তাড়ানোর উপায় বা কাকতাড়–য়ার সন্ধান দেননি কখনো। কারা কাউয়াদের আশ্রয় দেয়, সেটাও বলেননি। অথচ দলে কাউয়া বা কাক আছে, এ সত্য সবারই জানা। কাউয়া কীভাবে তাড়াতে হবে, সেই কাকতাড়–য়ার সন্ধান দেওয়াই বেশি জরুরি ছিলো। এই কাউয়াদের দল থেকে না তাড়াতে পারলে এরা কিন্তু সাফল্যের সব ফসল খেয়ে দেবে একে একে। তখন দোষ দেবেন কাকে? 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে এবারের নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া অত সহজ হবে না। বিএনপি অবশেষে ভোটে এলে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের সহযোগিতা ছাড়া পার পাওয়া যাবে না।   

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, স্বদেশ প্রতিদিন

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »






● সর্বশেষ সংবাদ  
● সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
অনুসরণ করুন
     
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : লুৎফর রহমান হিমেল
প্রকাশক: স্বদেশ গ্লোবাল মিডিয়া লিমিটেড-এর পক্ষে মোঃ মজিবুর রহমান চৌধুরী কর্তৃক আবরন প্রিন্টার্স,
মতিঝিল ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ১০, তাহের টাওয়ার, গুলশান সার্কেল-২ থেকে প্রকাশিত।
ফোন: +৮৮০২-৮৮৩২৬৮৪-৬, মোবাইল: ০১৪০৪-৪৯৯৭৭২। ই-মেইল : e-mail: swadeshnewsbd24[at]gmail.com, info[at]swadeshpratidin.com
● স্বদেশ প্রতিদিন   ● বিজ্ঞাপন   ● সার্কুলেশন   ● শর্তাবলি ও নীতিমালা   ● গোপনীয়তা নীতি   ● যোগাযোগ
🔝