বেশ কয়েক মাস ধরেই অস্থির দেশের ডিম, আলু, পেঁয়াজের বাজার। দাম ঠিক রাখতে ইতোমধ্যেই ডিম আমদানি করা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে বাজারে লাগাম টানতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের কোথাও ১২ টাকায় ডিম, ৩৫ টাকায় আলু ও ৬৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ মিলছে না। ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দামকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
উল্টো বাজারে ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না আলু। অর্থাৎ, এক কেজি আলুতে অন্তত ১৫ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজের সরকার নির্ধারিত দাম কেজিপ্রতি ৬৪ টাকা থেকে ৬৫ টাকা। তবে খুচরা বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকায়। অর্থাৎ, বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। যার ফলে এসব দাম নির্ধারণের ঘোষণাকে নাটক হিসেবে দেখছেন অনেকেই।
এর আগেও সরকার থেকে নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করার পর তা কার্যকর হতে দেখা যায়নি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে খোলা চিনি ১০৭ থেকে কমিয়ে ১০৪ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ থেকে কমিয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু সেই দাম ব্যবসায়ীরা মানেননি। তখন বাজারে চিনি ১১২ থেকে ১১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
এরপর গত জুনে সরকার প্রতি কেজি চিনিতে ১৬ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনি ১২০ এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু সেই দামও কার্যকর হয়নি। এখন বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে।
যদিও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মাঠে আছে ঠিকই। কিন্তু তাদের অভিযান বেশিরভাগ যে চুনোপুঁটি কেন্দ্রিক তা বোঝা যাচ্ছে। রীতিমতো নিম্ন আয়ের সাধারণ জনগণের জীবন নিয়ে খেলা হচ্ছে। উচ্চ মূল্যের বাজারে সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন অধিকাংশ মানুষ। যে হারে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তাতে করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তিনবেলা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলুন এবার দেশে উৎপাদিত পণ্য ডিম ও আলুর দাম নির্ধারণে কারসাজির ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখি। ডিম উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, খামারি পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৩১ পয়সা। প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১১ টাকা ধরলেও বিক্রয়মূল্য ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়, অথচ আগস্টে ডিমের মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে ১৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
ডিমের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তা অধিদফতর বিশেষ অভিযান চালানোর পর ডজনপ্রতি ডিমের দাম কিছুটা কেমেছিল। কিন্তু তত দিনে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির তথ্য মতে, দেশে দৈনিক চার কোটি ডিমের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে প্রতি ডিম দুই থেকে তিন টাকা বেশি দামে বিক্রি করলে দৈনিক বাড়তি মুনাফা হয়েছে ৮ থেকে ১২ কোটি টাকা।
এর আগেও গত বছরের আগস্ট মাসেও একইভাবে ডিম উৎপাদনকারী বড় ফার্মগুলো কারসাজি ও নিলামপ্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োগ করা এজেন্ট ব্যবহার করে ডিমের দাম বাড়িয়েছিল বলে অভিযোগ উঠে আসে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে।
সংস্থাটি ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ডিমের ক্রয়মূল্য যা-ই হোক না কেন, ডিমের ব্যবসার সাথে জড়িত সমিতিগুলো মুঠোফোনে মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে বাজার সে সময় অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। এভাবে কারসাজি করে ডিমের মূল্য নির্ধারণে প্রক্রিয়া উন্মোচিত হলেও এর পেছনে দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, ফলে ডিমের বাজারের কারসাজিও বন্ধ হয়নি।
এদিকে সরকারি হিসাবে দেশে এবার রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদিত হলেও আলুর দাম এক বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাজারে আলুর কেজি ৫০ টাকা ছুঁয়েছে, যা এক বছর আগেও ছিল ২০ থেকে ২২ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট ১ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়। আর গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদিত হয় ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার টন। অর্থাৎ এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার টন।
চাষিদের প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে সাড়ে ১০ টাকা, তারা আলু বিক্রি করেছেন ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। আর প্রতি কেজিতে ৫ টাকা সংরক্ষণ খরচসহ দাম দাঁড়ায় ১৮ থেকে ২০ টাকা। বছরের শুরুর দিকে ২৫ টাকায় আলু বিক্রি হলেও গত মে মাস থেকে বাড়তে থাকে। বর্তমানে ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না সেই হল্যান্ডের আলু। দেশে আলুর তো কোনো ঘাটতি নেই। হিমাগার থেকে চাহিদা অনুযায়ী আলু খালাস না করে একশ্রেণির সিন্ডিকেট ডিমের মতো কৃত্রিমভাবে আলুর দাম বাড়াচ্ছেন।
এবার আসা যাক মূল কথায়, দেশের সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের বাড়তি দরের চাপে কাতরাচ্ছে। কোনোদিকে কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। আশার আলোও দেখতে পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে পিষ্ট হচ্ছে অতি মুনাফার লোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে। ভুলে গেলে চলবে না, যে হারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে সে হারে সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না। অসাধুদের কারসাজির কারণেই এমন পরিস্থিতি।
অসাধুরাও সুযোগ পেয়ে বসেছে। তাদের নাম-পরিচয় সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে অজানা নয়; তারপরও তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি নিজেও এই সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করেছেন কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিলে সংকট তৈরি হওয়ার অজুহাত দেখিয়েছেন। যার ফলে, নানা ইস্যুতে প্রতিনিয়ত নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছেই।
লেখক: সাংবাদিক