মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের চিত্র
ছয়তলা ভবন পড়ে আছে, রোগীরা মেঝেতে
আরফিনুল ইসলাম, নীলফামারী প্রতিনিধি
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০২৩, ১:০৪ পিএম আপডেট: ২৩.০৫.২০২৩ ১:০৮ PM

২২ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবার একমাত্র ভরসাস্থল নীলফামারী জেনারেল হাসপাতাল। আর এই হাসপাতালের একটি ভবনের চতুর্থ তলা থেকে ছয়তলা পড়ে আছে প্রায় চার বছর ধরে। অথচ শয্যাসংকটের কারণে পুরোনো ভবনের ওয়ার্ড ও বারান্দার মেঝেতে ঠাঁই নিয়ে দিনের পর দিন চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন রোগীরা। অর্থবরাদ্দ না থাকায় থমকে আছে সিসিইউ ও আইসিইউ ভবনের কাজও। হাসপাতালটিতে নেই উন্নত চিকিৎসার জন্য নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি রয়েছে ওষুধ ও খাবার সংকটও। এছাড়াও ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা এই হাসপাতালে প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় চিকিৎসক না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও জনবলের অভাবে ভবনটি চালু করা যাচ্ছে না। জনবল ও অর্থ বরাদ্দ পেলে দ্রুতই ওই ভবনের কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

১০০ শয্যার হাসপাতালটি ২০১১ সালে ২৫০ শয্যায় উন্নীতের ঘোষণা হয়। ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫০ শয্যার সম্প্রসারিত ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। আটতলা ভিত্তির ভবনটির ছয়তলার নির্মাণকাজে সময় লাগে প্রায় ছয় বছর। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ভবনটি হস্তান্তর করে গণপূর্ত বিভাগ। এরপর ২৫০ শয্যার জন্য জনবল ও অর্থ বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানায় স্বাস্থ্য বিভাগ। তা না পাওয়ায় নতুন ভবনে শয্যা বাড়িয়ে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু না করায় সুফল পাচ্ছেন না রোগীরা। গাদাগাদি করে পুরোনো ভবনে চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা।


জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ২৭৩, হাসপাতালটিতে ৫৬ জন চিকিৎসকের পদে কর্মরত আছেন ২৯ জন। ১৫১ জন নার্সিং স্টাফের পদে আছেন ১৪৫, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ২৮ পদে আছেন ১২ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ২৭ পদে আছেন ২০ জন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় হাসপাতালের পুরোনো ভবনে শয্যা বাড়িয়ে ১৭০টি করা হয়েছে। এদিকে হাসপাতালের কয়েক দিনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই ওয়ার্ডগুলোতে নির্ধারিত শয্যার অতিরিক্ত রোগী থাকছেন। শয্যার অভাবে রোগীদের ঠাঁই নিতে হয় মেঝেতে।

মঙ্গলবার (২‌২মে) দুপুরে হাসপাতালের ৪২ শয্যার মহিলা ওয়ার্ডে ৬০ জন রোগী ভর্তি পাওয়া যায়। একইভাবে ২৫ শয্যার পুরুষ ওয়ার্ডে ৫০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। শয্যার সংকুলান না হওয়ায় বাধ্য হয়ে রোগীদের ওয়ার্ডের মেঝেতে ও বারান্দায় অবস্থান করে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গতকালও ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ৩২৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে শিশু ওয়ার্ডে ৪৫ জন, পুরুষ ওয়ার্ডে ৫৯ জন, মহিলা ওয়ার্ডে ৬১ জন, নবজাতক ওয়ার্ডে ২৫ জন, প্রসূতি ওয়ার্ডে ৪৫ জন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ২৩ জন ছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নার্স বলেছেন, এ দৃশ্য এখানকার নিয়মিত। ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিদিনই ধারণক্ষমতার বেশি রোগী থাকছেন। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে ওয়ার্ডগুলোতে অতিরিক্ত বিছানা ঢোকানো হয়েছে।

হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডের বারান্দায় কথা হয় সদর উপজেলার রামনগর এলাকার রফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন,  সকালে জ্বর, বুকে ও পিঠে ব্যাথা নিয়ে ভর্তি আছি। ভিতরে জায়গা নাই দেখি বাহিরে বেড করে দিছে, তাই এখানেই আছি। ডাক্তার এখনও দেখে নাই।


মহিলা ওয়ার্ডের মেঝে থেকে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন অমিছা বেগম। তিনি বলেন, বাড়িতে জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সাথে মারামারিতে মাথা ফেঁটে গেছে। কালকে হাসপাতালে ভর্তি হইছি। এখনো ডাক্টার দেখে নাই।  আমার মাথায় পাঁচটা সেলাই আমার বাবার বাবার মাথায় তিনটা। এখানে আমরা পড়ে আছি চিকিৎসা তেমন পাচ্ছি না। ঔষধপত্র আমাদেরকে বাহির থেকে কিনে খেতে হচ্ছে।

কচুকাটা এলাকার দুলাল হোসেন বলেন, মানুষের কাছত শুনছি নীলফামারী হাসপাতাল বিশাল কিন্তু আসি দেখেছি একটা বেডে চারটা রোগী। সময়তো ডাক্টার বাবু খুঁজি পাওয়া যায় না। আমার সরকারের কাছে দাবি বেড আরও বাড়ানো হোক কেবিন বাড়ানো হোক। একটা করে রোগী একটা করে বেডে থাকবে।

ডাইরিয়া ওয়ার্ড এক বেডে চিকিৎসা নিচ্ছে তিন শিশু। রাকিবুল ইসলাম  নামে এক শিশুর মা রোকেয়া বেগম বলেন, এক বেডে তিনজন চিকিৎসক কেমন করি নেয়। খুব সমস্যা হচ্ছে।  আমরা চাই বেড বাড়ানো হোক বেড বাড়াইলে আমাদের সুবিধা হইতো।

মেঝেতে চিকিৎসা নেওয়া কুলসুম আক্তার বলেন, চারদিন ধরি সর্দি জ্বর। এই যে নিচে শুতির লাগে বেড নাই বেড হলে ভালো হয়। অনেকজনে নিচে পড়ে আছি।  আর এভাবে থাকলে ওষুধ ভালো হওয়ার থেকে বাড়বে বেশি।

নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. গোলাম রসুল রাখি বলেন, এই হাসপাতালটি আগে ১০০ শয্যার হাসপাতাল ছিল, পরবর্তীতে এটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। আমাদেে নতুন বিল্ডিংয়ে শয্যা সংস্থাপন করতে পারিনি। পুরাতন বিল্ডিংয়ে  চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। আর  নতুন বিল্ডিংয়ের তিন তলা পর্যন্ত চালু করেছি। আমাদের হাসপাতালের অন্ত বিভাগে প্রতিদিন তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো রোগী ভর্তি থাকতেছে। এর মধ্যে ডাইরিয়া ও হিট স্টোকের রোগে আক্রান্ত হওয়া বেশি। বিশেষ করে বয়স্ক ও বাচ্চারা বেশি ভর্তি  রয়েছে। ডাইরিয়ার প্রকোপ টা কিছু কিছু জায়গায় দেখা যাচ্ছে,  এজন্য আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি। বহি বিভাগে আগের তুলনায় রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেড়েছে।  আমাদের হাসপাতালে লোকবলের সংকট রয়েছে। মঞ্জুরি পদের তুলনায় চিকিৎসক  ৫০ শতাংশ রয়েছে।  যা দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আবু-আল-হাজ্জাজ বলেন, আমাদের হাসপাতালটার ২৫০ শয্যার কার্যক্রম ২০২০ সালে চালু হয়। এখানে আগে ১০০ শয্যার কার্যক্রম চালু ছিল, সেখান থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত ১৫০ শয্যা সংস্থাপন করা যায় নাই। আমাদের নতুন বিল্ডিংয়ে ১০০ শয্যা চালু করা যাবে। নতুন বিল্ডিংটি আটতলা পর্যন্ত আমাদের প্লানে ছিল সেক্ষেত্রে ছয়তলা পর্যন্ত বরাদ্দ আসে। ছয় তলা ২০১৯ সালে কাজ শেষ হয়ে যায় এবং হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সাত তলার বরাদ্দ পরবর্তীতে আবার আসে এবং সাত তলার কার্যক্রম চলতেছে। যে ঠিকাদার এই কাজটা পেয়েছে গণপূর্ত বিভাগ থেকে তার ভাষ্যমতে এখন পর্যন্ত কোনো বিল পায়নি। আর বিল না পাওয়ার কারনে অসমাপ্ত যে কাজ লিফট লাগানো, যেটা দিয়ে রোগীর ট্রলি উঠবে, তারপর ওই বিল্ডিংয়ের জন্য যে আসবাবপত্র সেটার বরাদ্দ আমরা এখনও পাইনাই।

তিনি আরও বলেন, একারণে নতুন ভবনে তিন তলা পর্যন্ত আমাদের যে সেবাটা চালু করেছি। নিচ তলায় আমাদের জরুরি বিভাগের কার্যক্রম,  ফার্মেসী বিভাগের কার্যক্রম,  টিকেট কাউন্টার, রিসিপশন,  দ্বিতীয় তলায় আমাদের মেডিকেল অফিসার ও কনসাল্টেন্টদের দের সেবা কার্যক্রম পুরোদমে চালু আছে।  তৃতীয় তলায় নীলফামারী মেডিকেল কলেজের লেকচার রুম দেওয়া হয়েছে ও ব্লাড ট্রান্সমিউটেশন করা হয়।  আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব চালু করেছি। পরবর্তীতে যে এখানে ১০০ শয্যা থেকে শয্যা বর্ধিতকরণ নতুন ভবনের ৪র্থ থেকে ৬ষ্ট তলায় সম্পন্ন হবে। যেটা আমাদের আসবাবপত্রের বরাদ্দ পরবর্তীতে আসে এবং লিফট চালু হয় তাহলে আমরা চালু করতে পারবো।  সেটার জন্য আমরা উর্ধ্বতনকে জানিয়েছি এবং অপেক্ষা করতেছি। ঠিকাদার যে সাত তলা বিলটি পাঠিয়েছে  সেটা যদি দ্রুত পায় তাহলে আমাদের বাকি যে বর্ধিত অংশের কার্যক্রম সেটা চালু করতে পারব।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »






● সর্বশেষ সংবাদ  
● সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
অনুসরণ করুন
     
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : লুৎফর রহমান হিমেল
প্রকাশক: স্বদেশ গ্লোবাল মিডিয়া লিমিটেড-এর পক্ষে মোঃ মজিবুর রহমান চৌধুরী কর্তৃক আবরন প্রিন্টার্স,
মতিঝিল ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ১০, তাহের টাওয়ার, গুলশান সার্কেল-২ থেকে প্রকাশিত।
ফোন: +৮৮০২-৮৮৩২৬৮৪-৬, মোবাইল: ০১৪০৪-৪৯৯৭৭২। ই-মেইল : e-mail: swadeshnewsbd24@gmail.com, info@swadeshpratidin.com
● স্বদেশ প্রতিদিন   ● বিজ্ঞাপন   ● সার্কুলেশন   ● শর্তাবলি ও নীতিমালা   ● গোপনীয়তা নীতি   ● যোগাযোগ
🔝