শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
অগোচরেই থেকে গেল বাইশকাল গণহত্যার মর্মান্তিক দুর্ঘটনা
স্বীকৃতি পাননি শহীদরা
জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ: সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২২, ৫:০৮ পিএম
অগোচরেই থেকে গেল বাইশকাল গণহত্যার মর্মান্তিক দুর্ঘটনা
সেদিন ছিল ১৩ নভেম্বর শনিবার, ১৯৭১। কৃষ্ণপক্ষের একাদশী থাকায় বয়স্করা উপবাস থেকে সকাল সকাল মন্দিরে ভোগ আর নৈবদ্য সাজিয়ে পূজায় ব্যস্ত ছিল। এরই মধ্যে গ্রামের দিগন্তব্যাপি বেঁতের আড়া পেরিয়ে গ্রামে ঢুকলো শতাধিক খান সেনা ও রাজাকার আলবদর। গ্রামের উত্তর অংশ যেখানে হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি ছিল সেই পাড়া ঘেরাও করে গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে তারা। এরপর কয়েকজন খান সেনা চিৎকার করে বলতে থাকে, “সব মালাউনকা কাতারছে ঠাসো।” 

এরপর পাড়ার দেড়শতাধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বী যারা পালানোর সুযোগ পাননি, তাদেরকে ধরে এনে হালটে জড়ো করেন। এক পর্যায়ে বয়স্কদের কালেমা পড়িয়ে ধর্মান্তর করা হয়। আর শিশুদের ছেড়ে দেয়া হয়। আর দুইডজন যুবতী আর কিশোরীদের গানিমাতের মাল হিসাবে নাটমন্দিরের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। এক পর্যায়ে বেছে বেছে ১২ হিন্দু যুবককে রশি দিয়ে বেঁধে ভৌমিক বাড়ির পুকুর পাড়ে নিয়ে গুলি করে এবং বেনয়েট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এক ফাঁকে বর্বররা নাটঘরের পাশে আটকে রাখা অসহায় নারীদের অমানুষিক নির্যাতন করে। এরপর পাড়ার সব বাড়িতে লুটপাট শেষে আগুন দেয় হানাদাররা। এভাবেই একাত্তর সালের ১৩ নভেম্বর নগদাশিমলা ইউনিয়নের বাইশকাল গ্রামের পাইত্তা পাড়ায় গণহত্যা, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগ করার এমন মর্মান্তিক বর্ণনা দেন সাবেক যাত্রী শিল্পী নরেশ চন্দ্র (৮৪)। 

সেদিন পাকিস্তানি নরপশু এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদরের হাতে পিতাপুত্র, আপন ভাইসহ ১২ জন সংখ্যালঘু মানুষ শহীদ হন। এরা হলেন, গোবিন্দ চন্দ্র, উমাচরন চন্দ, ক্ষিতিশ চন্দ্র, বানিয়া চন্দ্র, মতি ভৌমিক, যোগেশ ভৌমিক, জ্যোতি ভৌমিক, গান্ধী ভৌমিক, জ্যোতিষ কর্মকার, ক্ষিতিশ চন্দ্র পাল, পূর্ণচন্দ্র পাল এবং পুত্র পুলকেশ পাল। 

নরেশ চন্দ আরো জানান, টানা দুই দিন শহিদদের লাশ পুকুর পাড়েই পড়েছিল। পরে পিস কমিটির কয়েক নেতার হস্তক্ষেপে পাকিস্তানি ক্যাম্পের অধিনায়ক শহিদদের লাশ দাহ নয়- মাটিচাপা দেয়ার অনুমতি দেন। সেদিন পাকিস্তানী হানাদাররা কেন পাইত্তা পাড়ায় গণহত্যায় চালিয়েছিলেন তা নিয়ে অনেকেই অনেক রকম তথ্য দিয়েছেন। 

কেউ কেউ বলেন, আতরবাড়ী, পোড়াবাড়ী ও চতিলা গ্রামের বহু মানুষ রাজাকার ও আলবদর বাহিনীতে গিয়েছিল। আতরবাড়ী গ্রামের মফিজ মেম্বার এবং চতিলা গ্রামের সমেশ আলী ছিলেন পাকিস্তানী দালাল এবং পীচ কমিটির সদস্য। এদের দুই আত্মীয় গোপালপুরে বেড়াতে গেলে খান সেনারা তাদের আটক করে। মফিজ মেম্বার তাদেরকে ছাড়ানোর জন্য তদবির করলে বিনিময়ে কয়েকজন হিন্দুকে ধরিয়ে দেয়ার শর্ত দেয় খান সেনারা। মফিজ মেম্বার হিন্দুদের সারেন্ডার করার পরামর্শ দিলে কোন হিন্দু পাকি ক্যাম্পে যেতে সাহস পায়নি। 

এমতাবস্থায় মফিজ মেম্বার শান্তি কমিটির অন্যান্য সদস্যদের পরামর্শে হানাদারদেরকে বাইশকাল পাইত্তা পাড়ায় ম্যাসাকার চালানোর আয়োজন করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল মফিজ মেম্বারের বিরুদ্ধে দালাল আইনে মামলা হয়। কিন্তু ধূর্ত মফিজ দীর্ঘদিন নানা জায়গায় পালিয়ে থাকে। পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কেউ তার বিরুদ্ধে আর সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে না আসায় অভিযোগ থেকে খালাস পায় দালাল মফিজ। এ

ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১ বছর কেটে গেছে। পাইত্তাপাড়ার পাশ দিয়ে প্রবাহমান আত্রাই নদী শুকিয়ে ক্ষীণকায় মরাআত্রাই নাম ধারন করেছে। গ্রাম জুড়ে থাকা পাটি বেঁতের আড়া ও বেতশিল্প বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো শহিদদের সরকারি স্বীকৃতি মিলেনি। তাদেরকে স্মরণে রাখার কোন স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদবেদী বা বধ্যভূমি নির্মিত হয়নি। এমনকি বধ্যভূমি চিহ্নিতও করা হয়নি। 

ওই গ্রামের প্রবীণ মোসলেম মন্ডল জানান, একাত্তরে গণহত্যার দিন ওই পাড়ার যেসব যুবতী সম্মানহানির শিকার হন পরবর্তীতে তাদের বিয়ে দিতে সমস্যা হয়। তাই অবস্থাপন্নরা গ্রাম ছেড়ে শহরে অবস্থান নেন। স্বাধীনতার পর ৭২ থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত পাইত্তাপাড়ার অবস্থাপন্ন গৃহস্থ বাড়িতে বেশ কটি চাঞ্চল্যকর ডাকাতি হয়। আশপাশের প্রভাবশালীরা হিন্দুদের জমিজামা দখলে নিতে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। অনবরত এসব চলায় ৮০ থেকে ৮৩ সালের মধ্যে পাড়ার সকল হিন্দুরা গোপালপুর পৌরশহরে অথবা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন। এভাবে ৭২ সালে যে পাইত্তাপাড়ায় তিনশতাধিক হিন্দু পরিবার বাস করতো সে গ্রামে এখন সাবেক যাত্রাশিল্পী নরেশ চন্দ্র ছাড়া আর কোন সংখ্যালঘু পরিবার নেই। 

ভূঞাপুর ইব্রাহীম খাঁ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রভাস চন্দ জানান, তার দাদা প্রসন্ন কুমার চন্দ তালুকদার বাইশকাল পাইত্তাপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। তার পিতা ডাক্তার প্রতাপ চন্দ পরবর্তীতে ঝাওয়াইল বাজারে গিয়ে বাসা করেন। প্রভাস তার মায়ের নিকট থেকে শোনা কাহিনী থেকে জানান, গণহত্যার দিন ওই গ্রামের বাসিন্দা বাবা উমাচরন আর পুত্র ক্ষিতিশ চন্দ্রকে এক রশিকে বেঁধে বধ্য ভূমিতে নিয়ে যায় হানাদাররা। গুলি করার আগে বাবা উমাচরন বারবার তার নববিবাহিত পুত্র ক্ষিতিশের প্রাণ ভিক্ষা চান। কিন্তু নরপশুরা সেদিন কোন কথাই শোনেনি। দুজনকেই এক সাথে গুলি করে হত্যা করে। আর সংসারের দুই অভিভাবককে এক সাথে হারিয়ে পরিবারটি পথে বসে। তিনি ওই পাড়ার বধ্যভূমিতে একটি
স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানান। 

সেদিনের ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বাইশকাল তালুকদারপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মতিয়ার রহমান জানান, গ্রামের বিশাল এলাকা জুড়ে বেঁতের আড়া থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই এখানে ঘাটি গাড়তেন। এজন্য হানাদার বাহিনী গ্রামবাসির উপর খুব ক্ষুব্ধ ছিল। এজন্য তারা সেদিন এ গ্রামে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। কিন্তু গ্রামের বধ্যভূমি ও গণহত্যার বিষয়টি কখনোই আলোতে আসেনি। কেউ আলোতে আনেনি। তিনি শহীদদের স্বীকৃতি, বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচার দাবি করেন। 

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক কমান্ডার সমরেন্দ্রনাথ নাথ সরকার বিমল জানান, গণহত্যাস্থল সংরক্ষণ এবং স্মৃতিস্তম্ব নির্মাণের জন্য সরকার ২০১২ সালে এলজিইডির মাধ্যমে দশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেন। কিন্তু সরকারি দলের অন্তর্কোন্দলের কারণে বধ্যভূমি সংরক্ষণ বা স্মৃতি সৌধ নির্মাণের কাজ না হওয়ায় বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত যায়। স্বাধীনতার ৫১ বছর পর এদেশে এতো কিছু উলটপালট হয়ে গেছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক অর্জন, ত্যাগ ও আদশের দিকগুলো ভুলে গেছি। না হলে সরকার যেখানে প্রতিটি বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় স্থান সংরক্ষণের তাগিদ দিয়েছেন সেসব স্থান এখনো অরক্ষিত এবং চিহ্নিত হয়নি। 

উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক জানান, ২০২১ সালে উপজেলা প্রশাসন হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুর গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ এবং শহিদদের নামফলক পাথরে খোদাই করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেছে। তেমনিভাবে নগদাশিমলা ইউনিয়নের বাইশকাল পাইত্তাপাড়ায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হবে।

লেখক: জয়নাল আবেদীন, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও সংবাদকর্মী।

স্বদেশপ্রতিদিন/এমএস



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »






● সর্বশেষ সংবাদ  
● সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
অনুসরণ করুন
     
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : লুৎফর রহমান হিমেল
প্রকাশক: স্বদেশ গ্লোবাল মিডিয়া লিমিটেড-এর পক্ষে মোঃ মজিবুর রহমান চৌধুরী কর্তৃক আবরন প্রিন্টার্স,
মতিঝিল ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ১০, তাহের টাওয়ার, গুলশান সার্কেল-২ থেকে প্রকাশিত।
ফোন: +৮৮০২-৮৮৩২৬৮৪-৬, মোবাইল: ০১৪০৪-৪৯৯৭৭২। ই-মেইল : e-mail: swadeshnewsbd24@gmail.com, info@swadeshpratidin.com
● স্বদেশ প্রতিদিন   ● বিজ্ঞাপন   ● সার্কুলেশন   ● শর্তাবলি ও নীতিমালা   ● গোপনীয়তা নীতি   ● যোগাযোগ
🔝