মিল্ক ভিটা—দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপননকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি সক্ষমতার অভাবে দুধ, কনডেন্সড মিল্ক ও পানির ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিল্ক ভিটার নিষ্ক্রিয় কারখানাগুলোকে ফের চালু করে প্রতিষ্ঠানটির ইউএইচটি মিল্ক, কনডেন্সড মিল্ক ও বোতলজাত পানির ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব ঠিকাদারকেই পালন করতে হবে। মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর চান বণিক বলেন, 'আমাদের পরিচালন দূর্বলতা ও কৌশলগত কারণে বন্ধ কারখানাগুলো চালু করা যায়নি। এখন আমরা এখান থেকে আয় বাড়াতেই (মিল্ক ভিটাকে) বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছি।' এ মাসের শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটি চারটা কারখানার মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য আগ্রহপত্র (ইওআই) আহ্বান করে। কারখানাগুলোর মধ্যে আছে দুটি ইউএইচটি মিল্ক প্ল্যান্ট, একটি কনডেন্সড মিল্ক প্ল্যান্ট এবং একটি ক্যান তৈরির প্ল্যান্ট। এছাড়াও একটি বোতলজাত পানির প্ল্যান্ট স্থাপন ও চালুও করতে হবে।
এই কারখানাগুলোর মধ্যে ক্যান তৈরি প্ল্যান্ট, কনডেন্সড মিল্ক প্ল্যান্ট ও একটি ইউএইচটি মিল্ক প্ল্যান্ট সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ঘাটে অবস্থিত। একটি ডেইরি প্ল্যান্ট সিরাজগঞ্জে, দ্বিতীয় ইউএইচটি মিল্ক প্ল্যান্ট ও দ্বিতীয় ডেইরি প্ল্যান্ট ঢাকায় এবং পানি বোতলজাত কারখানাটি নরসিংদীর শিবপুরে।
মিল্ক ভিটার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ব্যবসার পরিকল্পনা নেওয়া হবে। তা যাচাই-বাছাই ও উদ্যোক্তার সক্ষমতা বিবেচনা করে শর্টলিস্ট করা হবে। বাছাই করা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্ল্যান্টগুলো পরিদর্শন করে উৎপাদন সক্ষমতা, মার্কেটিং ব্যবস্থা, জমির ভাড়া, ব্র্যান্ড ভ্যালুসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রফিট শেয়ারিং নির্ধারণ করা হবে। দুই পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছালে তাদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হবে এবং উদ্যোক্তাকে 'মিল্ক ভিটা' ব্র্যান্ড নামে উৎপাদন ও বিপণনের অনুমোদন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ইওআই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, বন্ধ কারখানাগুলো চালু করতে যে পরিচালন ব্যয় দরকার, তা নির্বাচিত উদ্যোক্তাকেই বহন করতে হবে। কারখানার মেশিনের আধুনিকায়ন এবং প্রয়োজনীয় মেরামতও উদ্যোক্তাকে নিজ খরচেই করতে হবে। মিল্ক ভিটা কোনো ধরনের আর্থিক খরচ বহন করবে না।
চুক্তির মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। আলোচনার ভিত্তিতে তা বাড়ানো-কমানোও যাবে। কোনো উদ্যোক্তা চাইলে মিল্ক ভিটার মার্কেটিং চেইন ব্যবহার করতে পারবে, অথবা নিজেরাও মার্কেটিংয়ের জন্য লোকবল নিয়োগ দিতে পারবে।
মিল্ক ভিটার অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চুক্তির পর বেসরকারি উদ্যোক্তা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ খরচায় ব্যবসা পরিচালনা করবে। এখানে মিল্ক ভিটা কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
বন্ধ কারখানা
মিল্ক ভিটার তিনটি ইউএইচটি দুধ কারখানার দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ২ লাখ লিটার, কনডেন্সড দুধ উৎপাদনক্ষমতা দৈনিক ১ লাখ লিটার। তবে এই চারটি কারখানাই ৮-১০ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।
এদিকে বাজারে বোতলজাত খাবার পানির ব্যাপক চাহিদা থাকায় মিল্ক ভিটা এই খাতেও বিনিয়োগ করেছে। এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটি বছর তিনেক আগে নরসিংদীর শিবপুরে অবকাঠামো তৈরি করে। আমেরিকা থেকে মেশিনও কেনা হয়। কিন্তু এই ব্যবসায় সরকারি প্রতিষ্ঠানটির কোনো দক্ষতা ও লোকবল না থাকায় প্ল্যান্টটি চালু করতে পারেনি।
দেশে বোতলজাত পানির ব্যবসায় কোকা-কোলা, ইফাদ, পারটেক্স গ্রুপ, ট্রান্সকম, মেঘনা, একমি, প্রাণের মতো বড় কোম্পানিগুলোর মিল্ক ভিটা প্রতিদ্বন্দ্বী। এ ব্যবসায় এসব প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। পানি ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে দেশে বোতলজাত পানির বাজার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মিল্ক ভিটা পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে ও ব্যবসা বাড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু এই ব্যবসা পরিচালনায় যে সক্ষমতা প্রয়োজন, তা মিল্ক ভিটার নেই।
মিল্ক ভিটার বর্তমান ব্যবসা
১৯৭৩ সালে সমবায় ব্যবস্থাপনায় উৎপাদনে আসে মিল্ক ভিটা। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির ১১টি কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানার মধ্যেও আবার একাধিক পণ্য উৎপাদনের আলাদা আলাদা প্ল্যান্ট রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চালায় কৃষক সমিতি এবং তত্ত্বাবধান করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
মিল্ক ভিটা বর্তমানে দুধ ও দুগ্ধজাত ২২টি পণ্য প্রস্তুত ও বাজারজাত করছে। এর মধ্যে দুধ, দই, রসগোল্লা, লাবাং, মাঠা, ফ্লেভারড মিল্ক, মাখন, ঘি, সন্দেশ, রসমালাই কেক উল্লেখযোগ্য।
২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির টর্নওভার ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। যা দুই বছর আগে ছিল প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
মিল্ক ভিটা পাস্তুরিত দুধের বাজারে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা করছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে আড়ং, প্রাণ, আকিজ, আফতাব, রংপুর ডেইরি অন্যতম। দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ১৯ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়েছে। তবে সব ব্র্যান্ড মিলে প্রতি বছর সাড়ে সাত-আট লাখ মেট্রিক টন দুধ প্রসেস করে পাস্তুরিত দুধ ও ইউএইচটি দুধ বাজারজাত করছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে মিল্ক ভিটার পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় অন্য কোম্পানির মতো যখন-তখন বিপণন কৌশলে পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় না। পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে চকলেট ও আইসক্রিম কারখানাও চালু করেছিল মিল্ক ভিটা। কিন্তু বর্তমানে সেগুলো বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, চকলেট ও আইসক্রিম প্ল্যান্টগুলোও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
স্বদেশ প্রতিদিন/নিশাদ