বংগ-বাংগালা-বাংগালী ও বাংলা ভাষা
রফিকুল ইসলাম রতন
|
![]() রফিকুল ইসলাম রতন বংগ, বাংগালা, বাংগালী, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ। এই তাৎপর্যপূর্ণ বিশাল অর্থবোধক শব্দগুলো পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। পর্যায়ক্রমিকভাবে রূপান্তরিত বা আখ্যায়িত প্রতিটি শব্দের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের সঙ্গে রয়েছে বাংগালীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তথা নাড়ির সম্পর্কÑ যা অবিচ্ছেদ্য। বংগ, বাংগালা, বাংগালী ও বাংলা ভাষার ইতিহাসের আদিযুগ বা গঠনকাল, আনুমানিক ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়ের মধ্যেই যে দেশটির বা ভাষার নাম বংগ, বাংগাল, বাংগালা বা বাংগালী হয়েছেÑ এ বিষয়ে প্রখ্যাত ভাষাবিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন, দীনেশ চন্দ্র সেন এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্সহ অন্য সব মনীষীই একমত। তিরুমৈল লিপিতে ১০২৩ সালের আগেও অর্থাৎ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ের বৌদ্ধ পাল বংশের রাজত্বকালে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটতে থাকে। বৌদ্ধ নাথ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মৎসেন্দ্রনাথই বাংলা ভাষার আদি লেখক বা আদি কবি বলে পরিচিত। উত্তর ভারতের আর্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ নিয়ে যে বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশ ঘটেছিল, তা পরবর্তীকালে নিষ্পেষিত হয়েছিল আর্য-ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী মৌলবাদীদের হাতে। চর্যাপদের কবিদের হাতে বাংলা ভাষার গোড়াপত্তন হলেও দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আসা ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা বাংলাদেশ অধিকার করায় সেন বংশের বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯) কৌলিন্য ও বর্ণপ্রথা চালু করতে গিয়ে সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এ সময় বাংলা ভাষার চর্চা বন্ধ করে দেয়া হয়। এসব কারণেই বাংলাদেশের সমাজ ধর্ম ও বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে হিন্দু সেন আমল ছিল একটি ‘কালো’ অধ্যায়। সেন রাজাদের আমলে একদিকে যেমন বর্ণপ্রথার কঠোর পীড়নে ও শোষণে বাংলার সাধারণ মানুষ পিষ্ট ছিল, তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রায় লুপ্ত হতে চলেছিল। মুসলমান শাসন বাংলাদেশে স্থিতিশীল ও সুদৃঢ় হওয়ার পরই বাংলা ভাষার প্রকৃত চর্চা ও বিকাশ ঘটতে শুরু করে। এ ছাড়া ১২০৫ সালে সেন রাজ্যের গৌড় অংশ ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি দখল করে নেয়ার পর লক্ষণ সেন যে অঞ্চলে এসে রাজত্ব করেন, তার নাম উল্লেখ করা হয় বংগ নামে। এই বংগই আজকের বাংলাদেশ। এ জন্যই মুসলিম শাসনকালে ১৩৫০-১৮০০ সাল পর্যন্ত যুগটিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ বলা হয়ে থাকে। বাংলা যে সংস্কৃত থেকে আসেনি এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভাষাপণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’-এ বলেছেন, ‘বাংলা সংস্কৃতির দুহিতা নয়, তবে দূর সম্পর্কের আত্মীয়া মাত্র।’ পরবর্তীকালে অবশ্য মোগল যুগে (১৫৭৬-১৭৫৭) বাংলা ভাষায় উর্দু, হিন্দি ও ফারসির প্রভাব পড়তে শুরু করে। ইংরেজ শাসনের শুরুতে (১৭৫৭-১৮০০) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসি-উর্দুর প্রভাব দ্রুত বেড়ে যায়। ১৭৭৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর হয়ে আসার পর কোম্পানিতে চাকরিরত অক্সফোর্ডের পণ্ডিত প্যাথানিয়েল ব্রামি হ্যালহেডকে দিয়ে ১৭৭৮ সালে ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল’ নিয়ে একটি বাংলা ব্যাকরণ বই রচনা করেন। সংস্কৃতের আদলে লিখিত হুগলী থেকে প্রকাশিত এই ব্যাকরণ গ্রন্থটিই বাংলা হরফের প্রথম ছাপা পুস্তক। ১৮০১ সালে প্রতিষ্ঠিত কলিকাতার ফোর্ড উইলিয়াম কলেজে এই গ্রামার বই অনুসরণে বাংলা চর্চা শুরু হয়। নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ ১৯২১ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাবও পেশ করেন। রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ১৯১৮ সালে অনুষ্ঠিত ভাষা পণ্ডিতদের সভায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার বক্তৃতায় বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে ১৯২৩ সালের ‘ব্যাংগল প্যাক্ট’-এ সম্প্রদায়গত স্বার্থ, অবিশ্বাস ও সংশয় দূর করে হিন্দু-মুসলমানদের তিক্ততা নিরসনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল। বহু চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে, নানা রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র মোকাবেলা এবং দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি অগ্রসর হতে থাকলেও তা আবার প্রবল বাধা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়, উদ্ভট তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই। এই চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে গিয়ে সৃষ্টি হয় এক নজিরবিহীন ইতিহাস। সূচনা হয় নতুন এক অধ্যায়ের। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে যখন উর্দুকে নবসৃষ্ট পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গণ্য করার পক্ষে ওকালতি শুরু করেন, ঠিক তখনই তীব্র ভাষায় এর জবাব দেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ১৫ দিনের মাথায়ই ভাষার দাবিতে সৃষ্টি হয় ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামের সংগঠনটির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে সেদিন সৈয়দ নজরুল ইলাম, শামসুল হক, ফজলুর রহমান ভূঁইয়ার সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে জš§ নিয়েছিল এই তমদ্দুন মজলিস। সদ্যগঠিত তমদ্দুন মজলিস ’৪৭-এর সেপ্টেম্বরেই ভাষার দাবিতে সর্বপ্রথম ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু’ এই নামে একটি ভীষণ সাহসী সংকলন প্রকাশ করে। সংকলনে অধ্যাপক আবুল কাশেম, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল মনসুর আহমদ রচিত তিনটি নিবন্ধে বাংলা ভাষা কেন রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত পাবে তার সপক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। এরই মাঝে ভাষার দাবিকে আরও বেগবান এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনে ৭ সেপ্টেম্বরে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে নবগঠিত এই দল আরও জোরদার করে। ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের কাছে রশিদ বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে বসেই ঘরোয়া পরিবেশে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। প্রথম এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে। কিন্তু নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদ উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি ঘোষণা এবং সাংগঠনিক তৎপরতার ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য দেখাতে না পারায় আন্দোলনকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ’৪৮-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে, গণপরিষদের আলোচনায় বাধ্যতামূলক ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম বাংলা ভাষার পক্ষে সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন এবং বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দানের দাবি জানান। পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য প্রেমহরী বর্মণ, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শীলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও সেদিন তার এই দাবিকে জোরালো সমর্থন করেন। বাংলা ভাষার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’-এর উদ্যোগে ফজলুল হক মুসলিম হলের সাহিত্য সভায়ও বাংলা ভাষার জোর দাবি জানানো হয়। এ বছরই ১৭ নভেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয়। এই স্মারকলিপিতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, আইনজীবী, লেখক, অধ্যাপক, ছাত্র, ডাক্তার, রাজনৈতিক নেতা ও মহিলাসহ শত শত নাগরিক স্বাক্ষর করেন। ভাষার দাবিতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রথম সংগ্রাম পরিষদ তেমন কোনো ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় গণপরিষদে ভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, প্রগতিশীল লেখক সংঘ এবং হলের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক বৈঠক আহ্বান করা হয়। বাংলা ভাষার আন্দোলনকে অচিরেই গোটা পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রথম সংগ্রাম পরিষদকে পুনর্গঠন করে গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। বিভিন্ন সংগঠনের ১৪ জন প্রতিনিধি এবং বহু নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে এ অধিবেশনের আহ্বায়ক মনোনীত হন স্যার সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রনেতা শামসুল হক। বৈঠকে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সংগ্রাম পরিষদের শাখা গঠন এবং ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়Ñ ইডেন বিল্ডিংয়ের প্রথম ও øিতীয় গেট, রমনা পোস্ট অফিস, পলাশী, নীলক্ষেত ব্যারাক, জেলা আদালত, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেট, রেলওয়ে প্রভৃতি এলাকায় কড়া পিকেটিং করা হবে। ১১ মার্চ খুব ভোর থেকেই সাহসী যুবনেতা শেখ মুজিবের নেতত্বে সেক্রেটারিয়েট গেট, তোপখানায় শামসুল হকের নেতৃত্ব কড়া পিকেটিং হয়। একপর্যায়ে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। শামসুল হক, শেখ মুজিব, কাজী গোলাম মাহবুব ও অলি আহাদসহ বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী আহত হন। এর প্রতিবাদে আইনজীবীরা কোর্ট বর্জন করেন। ১৩ মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট শুরু হয়। শুরু হয় শিল্প-কারখানায় ধর্মঘট। ব্যাপক আকার ধারণ করে ভাষা আন্দোলন। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমনকে কেন্দ্র করে তখন সরকার একটু নমনীয় কৌশল বেছে নেয় এবং সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বিনাশর্তে সাত দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির শর্ত মোতাবেক গ্রেফতারকৃতরা মুক্তি পান। ১৬ মার্চ সংসদ ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন নেতারা। পুলিশ ব্যাপক নির্যাতন চালায়। ১৭ মার্চ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকা হয়। জিন্নাহ সাহেব ঢাকা আসেন ১৯ মার্চ। ২১ মার্চ বিকালে রেসকোর্সে আয়োজিত তার সংবর্ধনা সভায় তিনি বললেন, ‘কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই জনসভা থেকে শামসুল হক, অলি আহাদ, শেখ মুজিবসহ অন্যরা সমস্বরে নো নো বলে চিৎকার করে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ২৪ মার্চ জিন্নাহর সঙ্গে ছাত্রদের বৈঠকে শামসুল হক তার অসাধারণ বাগ্মিতা দিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। ১১ সেপ্টেম্বর ’৪৮ সালে আকস্মিকভাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করলে শাসকগোষ্ঠীর উত্তেজনা কিছুটা স্তিমিত হয়। পরে ১৯৫০ সালের ৯ মার্চ গঠিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। আহ্বায়ক হন আবদুল মতিন। নবগঠিত পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবসও উদযাপন করে। ছাত্রদের প্রবল চাপে জেল থেকে মুক্তির পরেই শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫১ সালের ২৭ ও ২৮ মার্চ বুড়িগঙ্গার ভাসমান নৌকায় দুই দিন সম্মেলন করে গঠন করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’, যা পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। লিয়াকত আলী খানের হত্যাকাণ্ডের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী উর্দুভাষী খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করে সুপ্ত আগুনে ঘৃতাহুতি দেন। এর পর থেকেই দ্বিতীয় দফায় শুরু হয় আবার ভাষা আন্দোলন। ৩০ জানুয়ারি সংগ্রাম পরিষদের সভায় তীব্র ভাষায় খাজা নাজিমউদ্দিনের ঘোষণার প্রতিবাদ করা হয় এবং বের হয় একটি স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। মিছিলটি ফুলার রোডের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমী) পাশ দিয়ে গিয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী আন্দোলনের তারিখ ঘোষণা করে। এদিন পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। ওইদিনই বিকালে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা বিরোধী দলের নেতাদের যৌথসভায় গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। নবগঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গের গণপরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিনকে ভাষা দিবস ঘোষণা করে দেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ ও শোভাযাত্রার কর্মসূচি দেয়। ৪ ফেব্রুয়ারি পালনকে কেন্দ্র করে নেতাদের মাঝে দেখা দেয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব। ভাষার দাবিতে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তথা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতারা যখন ৪ ফেব্রুয়ারি আমতলায় সভা করার জন্য চেয়ার-টেবিল সংগ্রহে ব্যস্ত, তখন এমআর আখতার মুকুল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সভাপতি হিসেবে গাজীউল হকের নাম ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে কমরুদ্দিন শহুদের সমর্থনে টেবিলের ওপর উঠে গাজীউল হক এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে প্রায় ১০-১২ হাজার ছাত্রছাত্রীকে উদ্বুদ্ধ করেন। অন্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় বিশাল বিক্ষোভ মিছিল। মিছিল শেষে আমতলার জমায়েতে প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি হরতালের সমর্থন জানিয়ে জেলখানা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে চিরকুট লিখে পাঠান। নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের সমর্থনে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ওইদিন দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। খাজা নাজিমউদ্দিন জারি করেন ১৪৪ ধারা। নিষিদ্ধ করা হয় সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রা। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নবাবপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে পরিস্থিতি মোকাবেলায় খেলাফতে রব্বানী পার্টির নেতা আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের জরুরি সভা। বৈঠকে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত পাস হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মোহাম্মদ তোয়াহা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেও তিনি ভোটদানে বিরত থাকেন। সিদ্ধান্তের সঙ্গে ছাত্রসমাজের একটি অংশও দ্বিমত পোষণ করে। পরে ১১ জন সাহসী নেতৃস্থানীয় ছাত্র ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা হল ও ফজলুল হক হলের মধ্যবর্তী পুকুরের পুবপাড়ের সিঁড়িতে গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, এমআর আখতার মুকুল, এসএ বারী এটি, কমরুদিন শহুদ, জিল্লুর রহমান, আবদুল মোমিন, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর এবং আনোয়ার হোসেনসহ ১১ ছাত্রনেতার সংক্ষিপ্ত বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় প্রথমে গাজীউল হক বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন। তিনি গ্রেফতার হলে এমআর মুকুল সভাপতি হবেন। তিনি গ্রেফতার হলে সভাপতি হবেন কমরুদ্দিন শহুদ। আর সত্যাগ্রহীদের প্রথম মিছিলে নেতৃত্বে দেবেন হাবিবুর রহমান শেলী। আবদুল মোমিনের পরামর্শেই শেষ রাতেই ছাত্রনেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর ডিঙিয়ে প্রভাতি সূর্যের প্রতীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে অবস্থান নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা ভোরেই অসংখ্য পুলিশ ঘিরে রাখে। ভোর থেকে আসতে থাকেন অসংখ্য ছাত্র। তাদের মধ্যে ছিল মারমুখী উত্তেজনা। এ সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে বক্তব্য দিতে এসে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক লাঞ্ছিতও হন। বিপুলসংখ্যক ছাত্র সমবেত হওয়ার পর গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভা হয় এবং ১০ জন ১০ জন করে স্লোগান দিয়ে মিছিল করে, অ্যাসেম্বলি হাউসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। হাজারও ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান-মিছিল শুরু হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশ। টিয়ার গ্যাস, গুলি, লাঠিচার্জ ও ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে তারা। ছাত্ররাও পাল্টা হাতে তুলে নেয় ইটপাটকেল। বেলা ৩টা ১৪ মিনিটে ভাষার জন্য পুলিশের গুলিতে প্রাণ গেল অকুতোভয় চারজনের। রাতে হয় আবার বৈঠক। এবার অলি আহাদকে আহ্বায়ক করা হয়। জেলে শুরু হয় ভাষার দাবিতে অনশন। ধর্মঘট ও হরতাল চলতে থাকে গোটা দেশে। তারপর অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের আরও চার বছর পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর ৪৪ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৬ নভেম্বর, ‘আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রভাষা দিবস’-এর ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়ে গোটা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে। এটা বাঙালির ঐতিহাসিক গৌরব। ভাষা আন্দোলন কবে শুরু কবে শেষ : ভাষা আন্দোলন কবে শুরু কবে শেষÑ এ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি ও অস্বচ্ছতা রয়েছে। সাধারণভাবে একটা ধারণা, ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু এবং ১৯৫২-এ শেষ। ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর ভাষা আন্দোলনে কী হয়েছিল, তার আগে কী কী ঘটেছিল, কতদিন চলেছিল এবং কেন চলেছিলÑ তা জানার আগ্রহ অনেকেরই নেই। যেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়েছিল। প্রকৃত ইতিহাস জানার প্রতি অনাগ্রহ কোনো জাতির জন্যই শুভ লক্ষণ নয়। অনেক পণ্ডিত, গবেষক মনে করেন, ১৯৫২-এর তুলনায় ১৯৪৮-এর অবদানকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে ইতিহাসে ১৯৫২-এর অভিঘাত খুব গভীর। ভাষা আন্দোলনের মতো এতবড় একটি গণআন্দোলন যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়নি, তেমনি একদিন তা শেষও হয়ে যায়নি। অনেকে মনে করেন ভাষা আন্দোলন এখনও চলছে। সেদিনের স্বপ্ন আজও বাস্তবায়িত হয়নি। একদিন তা শেষও হয়ে যায়নি। বাস্তবায়িত হয়নি আত্মত্যাগকারীদের ইচ্ছা। ভাষা আন্দোলনে তথা ১৯৫২ সালের পর প্রায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও সেদিনের শহীদদের যথার্থ সম্মান দেখানো হয়নি। যারা প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদাকে রক্ষা করে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায় তারা এতকাল ছিল উপেক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত। দীর্ঘ ৪৮ বছর পর গত বছর সরকার পাঁচ ভাষাশহীদকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করলেও তাদের পরিবারের অবস্থার খোঁজ কেউ রাখে না। অনাদর-অবহেলায় আজও ভাষাসৈনিক সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউলের কবর পড়ে রয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা কে কোথায়, কেমন অবস্থায় আছেন সরকারও সে খোঁজ রাখে না। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের সরকারি নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারেরও তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি শিল্পী হামিদুর রহমানের মূল নকশা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এই দুঃখবোধ নিয়ে শিল্পী হামিদুর রহমান ১৯৮৮ সালের ১৯ নভেম্বর মন্ট্রিলে মৃত্যুবরণ করলেও সেদিকে কারও খেয়াল নেই। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষার দরদ যেন আমাদের সবার উথলে ওঠে। বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখালেখি ও কথামালার খৈ ফুটতে থাকে। কিন্তু এসব হৈহুল্লোড়ের আবেগের মাঝে আসল অনেক বিষয়ই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ইউনেস্কোর সুবাদে আমাদের মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভবাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৯২টি দেশে উদযাপিত হলেও উল্লেখিত সমস্যা সমাধানে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। যাক, যে কথা শুরু করেছিলাম। ভাষা আন্দোলন চলেছিল সাড়ে আট বছর। ১৯৪৭-এর জুনে মূলত ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। শেষ হয় ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূলত চল্লিশের দশকেই শুরু হয় ভাষা নিয়ে বিতর্ক। তখনকার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস প্রথমে দাবি তোলে উর্দুু ও হিন্দি নিয়ে। কিছুটা উদ্ভট ও বেখাপ্পা শোনা গেলেও সেদিনকার প্রগতিশীল রাজনীতিকরা মুসলিম লীগের ব্যানারে উর্দুর পক্ষাবলম্বন করেন। আর কিছু ধর্মীয় চেতনায় বিশ্বাসী ও অন্যরা চান হিন্দি। প্রথম দিকে প্রগতিশীল ও অপ্রগতিশীলদের মাঝে এই দাবির লড়াই চললেও পরে তা ধর্মে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মুসলমানরা উর্দুর পক্ষে আর হিন্দুরা হিন্দির পক্ষ নেন। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সময়েও এ অবস্থা বিরাজ করছিল। পরে নানা চড়াই-উৎরাই ও কূটনৈতিক চালের মধ্য দিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ‘পাকিস্তান’ নামের নতুন রাষ্ট্রের জš§ হলো তখনও কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের মাথায় উর্দুর ভূত খেলা করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে হিন্দি, পাঞ্জাবি, বেলুচ, ফার্সিসহ বেশকিছু আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত থাকার পরও উর্দুপ্রীতিদের নেতৃত্বের চাপে পুরো পাকিস্তানে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলো উর্দু। এই প্রেসার গ্রুপ এতই শক্তিশালী ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে এসে ব্যারিস্টার জিন্নাহর ইংরেজিতে ভাষণ দেয়ার কথা থাকলেও তাকে দিয়ে উর্দুতে ভাষণ দেয়ানো হয়। এভাবেই চলতে থাকে উর্দু ভাষা-ধর্মান্ধদের চক্রান্ত। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান হওয়ার তিন মাস আগের কথা। তখনও ভারত ভাগ হয়নি। সৃষ্টি হয়নি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা। ওয়ার্কিং কমিটির প্রভাবশালী সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান সভায় ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে উর্দুু। খবরটি প্রকাশিত হয় ১৯ মে দৈনিক আজাদে। পত্রিকায় এই খবর দেখেই বাংলাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে দুটি নিবন্ধ লেখা হয়। ২২ ও ২৯ জুন কিস্তিতে প্রকাশিত হয় কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদে এবং ৩০ জুন অপর নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদে। ওই জুনেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে কর্মী সম্মেলন শেষ করে কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে ঢাকায় চলে আসেন কমরুদ্দীন আহমদরা। খাজা নাজিমউদ্দিনের ভবিষ্যতের সব আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হওয়ার জন্য ঢাকায় ‘গণআজাদী লীগ’ নামক একটি দল গঠিত হয়। মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দিন প্রমুখ গণআজদী লীগ থেকে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এরপর ২০ জুলাই ইত্তেহাদে আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন মাহবুব জামাল জাহেদী। তিনি বাংলার পাশাপাশি উর্দুকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ’৪৭-এর জুলাইয়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, নবসৃষ্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এর প্রতিবাদে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নিবন্ধ লিখে উর্দুু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এ সময়েই আরও কেউ কেউ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তোলেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে সাংগঠনিকভাবে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে ‘তমদ্দুন মজলিস’। পাকিস্তান সৃষ্টির এক মাসের মাথায় ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শামসুল হক, ফজলুর রহমান ভূঁইয়া প্রমুখ জড়িত হন এ সংগঠনের সঙ্গে। তমদ্দুন মজলিস সেপ্টেম্বরেই ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ এই শিরোনামে তিনটি প্রবন্ধের একটি সংকলন প্রকাশ করে। এটিই ভাষার দাবিতে প্রথম সংকলন। ৭ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। তৎকালীন তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত এই যুবলীগ দাবি জানায়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার একমাত্র ভাষা হবে বাংলা’। পয়লা অক্টোবর তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবের প্রচেষ্টায় গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগও ভাষার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে একটা জনমত সংগঠিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে শুরু হয় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন। এ অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের জন্য গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর গঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’-এর পক্ষ থেকেও বাংলার পক্ষে জোরালো দাবি তোলা হয়। ’৪৮-এর ২ মার্চ সব সংগঠনের সম্মিলিত সভায় প্রথম সংগ্রাম পরিষদকে পুনর্গঠিত করে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সচিবালয়ের গেটে এই ধর্মঘটে পিকেটিং করার সময় শামসুল হক ও শেখ মুজিবসহ আরও অনেক নেতা গ্রেফতার হন। পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জে বহু আহত হন। ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বিনাশর্তে সাত দফা চুক্তির প্রস্তাব করেন। জেলখানায় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ মোতাবেক বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমী) গিয়ে কমরুদ্দিন আহমদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি মোতাবেক জেল থেকে নেতারা মুক্তি পান। চলতে থাকে আন্দোলন, সংগ্রাম, ধর্মঘট। ১৯ মার্চ আসেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ২১ মার্চ রেসকোর্সে নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে ভাষণ দেন। সভা থেকে তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে জিন্নাহর মৃত্যুর পর শাসকগোষ্ঠীর মনোভাবে কিঞ্চিত ভাটা পড়ে। এ সময়েই শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের আন্দোলন। শেখ মুজিব এ আন্দোলন সমর্থন করায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ১৯৫০ সালে ৯ মার্চ আবার নতুন করে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চকে তখন রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। ’৫১-এর ২৭ মার্চ গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’। আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ১৬ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে নিহত হন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। নতুন করে প্রধানমন্ত্রী হন উর্দুভাষী সেই খাজা নাজিমউদ্দিন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় তিনি জিন্নাহর ঘোষণা পুনরাবৃত্তি করেন। শুরু হয় প্রতিবাদ। ২১ ফেব্রুয়ারি বাজেট অধিবেশনের দিনকে ভাষা দিবস ঘোষণা করে মিছিল হয়। জেলখানা থেকে ভাষার দাবিতে শেখ মুজিবসহ নেতারা অনশন শুরু করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে মিছিলের সিদ্ধান্ত হয়। ডাক দেয়া হয় ২১ ফেব্রুয়ারিতে দেশব্যাপী হরতালের। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে প্রাণ দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শফিউরসহ অনেকে। সে ঘটনা সবারই জানা। আড়াই বছর কারাভোগের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পান। ৯ জুলাই কাউন্সিলে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পুনরায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫৪ সালে ৮ থেকে ১২ মার্চের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। ১১ দিনের মাথায় মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়। ৩১ মে পুনরায় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতিদান এবং পূর্ববাংলার নাম পাল্টিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করা হয়। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয় এই সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। আর ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতের দিনটিকে ভাষা দিবস ঘোষণা করে চলতে থাকে রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপন। এভাবেই শেষ হয় ভাষা আন্দোলন। (১৯৯৬ সালের ৩ মার্চ দৈনিক বাংলার বাণীতে প্রকাশিত) |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |