মধ্যস্বত্বভোগীদের খপ্পরে দিশেহারা কৃষক
কে এম মোস্তাক আহম্মেদ
|
![]() কে এম মোস্তাক আহম্মেদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, উৎপাদন ও চাহিদার বিবেচনায় দেশে খাদ্য সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু তার সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। সবই চলে যাচ্ছে ফড়িয়াদের হাতে। আগামী জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত থাকবে কমপক্ষে ২৮ লাখ টন চাল। দেশে ২৮ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা সত্ত্বেও বর্তমানে মোটা চালের কেজি ৫০-৫৫ টাকায় পৌঁছে গেছে। এই করোনাকালে এমনিতেই সাধারণ মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে ভীষণ মন্দাভাব। কাজ হারিয়ে বহু মানুষ বেকার জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ একটা কৃষিপ্রধান দেশ হলেও খাদ্য উৎপাদনের তুলনায় আমদানি নির্ভরতা কম নয়। তাই তো করোনা মহামারির কারণে আসন্ন খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জনগণকে পরামর্শ দিয়েছেন এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি ও খালি না রাখার। কীভাবে কৃষিপ্রধান দেশে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের জন্য হলেও ভূমি সংস্কার জরুরি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজকের চীন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়া। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এদেশের কৃষি অনেক আগেই হাইব্রিড, রাসায়নিক ও কীটনাশকের কবলে বন্দি হয়ে পড়ায় এর সুফল ভোগ করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এভাবে কৃষককে বীজ, সার, কীটনাশকের কবলে ফেলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কৃষিতে দেওয়া ভর্তুকির টাকা লুট করে নিয়ে যায়। কৃষক এদের কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, এদেশের কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে নানা পরামর্শ দিয়ে থাকে। এটি যতটা না কৃষকের স্বার্থে তার চেয়ে বেশি তাদের স্বার্থকে প্রসারিত করার জন্য। যদিও ইতিহাস থেকে নীলচাষের বাস্তবতা এখনো মানুষ বিস্মৃত হয়নি, তথাপি নীলচাষ মানব খাদ্য ও পশু খাদ্য উৎপাদনের রূপ ধরে এখনো বহু উন্নয়নশীল দেশে বিদ্যমান আছে। মূলত কৃষিকে কৃষকবান্ধব করে তোলার বা দেশে একটা কৃষি বিপ্লব ঘটানোর সদিচ্ছা কোনো সরকারের মধ্যেই তেমন দেখা যায়নি। তাই তো ‘হাইব্রিড বীজের দরকার নেই’ বিশেষজ্ঞরা এমন মতামত দিলেও বাণিজ্যের কারণে সরকার তা এড়িয়ে যেতে পারে না। অথচ এদেশের কৃষক কৃষিকে তার জীবন ধারণের উপায় হিসেবে নিলেও কখনো বাণিজ্য হিসেবে নিতে পারে না, বা সেই সুযোগ তার নেই। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত থেকেছে বরাবরই। কৃষি পণ্যের মাঠপর্যায়ের মূল্য ও বাজার মূল্যের পার্থক্য যোজন যোজন দূরে। এক্ষেত্রে সরকারকে কখনো কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সেভাবে ভর্তুকি দিতে দেখা যায় না। গত কয়েক বছর ধরে কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ধানের উৎপাদন কম হলেও, তা ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। সরকারি গুদামে মজুদ কমে গেলে তারা ইচ্ছামতো চালের দাম বাড়ান। তাই চাল আমদানি করা কিছুটা যৌক্তিক হলেও বেশি আমদানি হলে আগামী মৌসুমে ধানের দাম পাবেন না কৃষক। বিশ্ব যখন খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় রয়েছে, সেখানে এটা নিঃন্দেহে খুশির খবর; কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের অজুহাতে সরকার ভারত থেকে দশ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথাপি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পাঁচ মাস আগে আভাস দিয়েছিল যে, এ বছরের শেষে প্রায় সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। অথচ বাজারে সব ধরনের চালের দামই বেড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে ৬২.৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির কি কারণ থাকতে পাওে, তা বোধগম্য নয়। তবে ভারতের চাল রফতানিকারকরা বলছেন, বাংলাদেশে এই বিপুল পরিমাণ রফতানির ফলে ভারতের চাল রফতানির ক্ষেত্রে এবার রেকর্ড হতে চলেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কৃষকরা বোরো মৌসুমে ধান রোপণ করবেন কি-না, করলে ন্যায্য দাম পাবেন কি-না- এ নিয়ে দোলাচলে ভুগছেন। এই সংকটের সময়ে চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের পাঁচ কোটি গরিব মানুষ পড়েছে মহাবিপদে, যাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি ক্রয়ে। চালের মূল্যবৃদ্ধি-সংক্রান্ত ব্যাপারে সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আড়তদার-মিলাররা কারসাজি করে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। খাদ্য নীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) কথা বাজারে দ্রুত চালের জোগান না বাড়লে দাম আরও বেড়ে যাবে। এতে গরিব মানুষের বিপদ আরও বাড়বে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ২০ লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। বাজারে দাম কমাতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ই ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ১০ লাখ টন চাল দিয়ে মূলত সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে আরও ১০ লাখ টনের মতো চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হতে পারে। বাজার নিয়ন্ত্রণে না এলে সেটা আরও পাঁচ লাখ টন বাড়ানো হতে পারে। এরই মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের ভারত থেকে আমদানি করা ৫০ হাজার টন চাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছে। আরও ৪৫ হাজার টন পথে রয়েছে। ভারত থেকে চার লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে আড়াই লাখ টন এবং রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে দেড় লাখ টন চাল আনা হচ্ছে। যারা মজুদ করেন তারা সব সময় সরকারি গুদামের দিকে খেয়াল রাখেন। সরকারি গুদামে মজুদ কমে গেলে তারা ইচ্ছামতো চালের দাম বাড়ান। তাই চাল আমদানি করা কিছুটা যৌক্তিক হলেও বেশি আমদানি হলে আগামী মৌসুমে ধানের দাম পাবেন না কৃষক। গত আগস্ট মাসে খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা; ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) পক্ষ থেকে সরকারকে চালকল মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি খোলা দরপত্রের মাধ্যমে চাল সংগ্রহের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় সেই পরামর্শ আমলে নেয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কথা ২০১৭ সালের মতো অনিয়ন্ত্রিতভাবে এবার চাল আমদানি করা হবে না। কেউ আমদানি করতে চাইলে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে তারপর তারা আমদানি করতে পারবেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে চালের ঘাটতি আছে, তা বাজারের অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। এরই মধ্যে চীন আমদানি শুরু করায় বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে ভারত থেকে চাল আমদানির খবরে দিনাজপুরের আড়তে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে, তবে চালের দাম একই আছে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য, বিশেষ করে ধানের ন্যায্য দাম কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ধানের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হলে মৌসুমের শুরুতে কৃষকের কাছ থেকে বেশি করে ধান কিনতে হবে। সরকার এবারও ধান কিনেছে খুব কম। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা কখনোই পূরণ হয় না। চাল কৃষকের কাছ থেকে না কিনলেও সরকার মিল মালিকদের কাছ থেকে কিনতে পারে; কিন্তু ধান কিনতে হবে কৃষকের কাছ থেকেই। আর কৃষকের লাভ-লোকসানের ক্ষেত্রে কেবল ধান-চালের দাম দেখলে হবে না। উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। সার, বীজ ও সেচে আরও বেশি ভর্তুকি দিতে হবে। কৃষক যাতে তার পণ্যটির উপযুক্ত দাম পান, সে জন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। ১৯৮১ সালে সুইস সরকারের সহায়তায় ২৫ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন গুদাম তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে মৌসুমের শুরুতে প্রান্তিক ও ছোট কৃষকরা পণ্য রেখে দিতেন। প্রয়োজনের সময় বিক্রি করতেন। পরবর্তীকালে প্রকল্পটি এগোয়নি। প্রকল্পটি আবারও চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা মধ্যস্বত্তভোগীরাই যুগে যুগে লাভবান হবে প্রান্তিক কৃষক নয়। আমদানির ক্ষেত্রে সরকারকে পরিকল্পিতভাবে যতটুকু দরকার ততটুকুই আমদানি করতে হবে। তা না হলে আবারও ঠকবেন কৃষকরা। অতিরিক্ত আমদানি হলে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবে কৃষক। তাই খেয়াল রাখতে হবে যেন আমদানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। লেখক : সাংবাদিক
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |